
১
আমি হামেশাই একটা আশ্চর্য বধ্যভূমির স্বপ্ন দেখি, উটমুখো গোবেচারা টাইপের একটা লোক শ্যাওলা ধরা ভাঙাচোরা ইটের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় সম্ভবত দেওয়ালটার গায়ে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল স্লোগান লেখা ছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলির চিহ্ন তার ওপর নিরক্ত স্থলপদ্মর মতো ফুটে আছে। ক্ষতবিক্ষত শব্দগুলোকে লোকটা নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রেখেছে, যেন তার এজমালি সম্পত্তি, আলগা ছাড়লেই কেউ জোর করে দখল নিয়ে নেবে। একটু দূরে এক দল জহ্লাদ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এইখানটায় সাধারণত একটা অবাস্তব ব্যাপার থাকে, স্বপ্নে যেমন হয় আর কি! আমি পরিষ্কার দেখতে পাই জহ্লাদদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছে, চোখে কালো কাপড়ের ফেট্টি লাগানো, অথচ রাইফেলগুলো উদ্যত। বুঝতে পারি না, জহ্লাদগুলোর কি দেবতাদের মতো চারটে করে হাত? নাকি রাইফেলগুলোর নিজস্ব হাত আছে? একটা জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরা লোক উঁচু পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, ইউনিফর্মটা যেন মানুষের কাঁধে নয়, হ্যাঙ্গার থেকে ঝুলছে। এই লোকটা মনে হয় জহ্লাদগুলোর লীডার, আদৌ যদি লোক হয়। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, মুখের জায়গায় ঘন অন্ধকার। লোকটার বাড়িয়ে রাখা ডান হাতে একটা কালো রুমাল টাঙানো রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে রুমালটা খসে পড়বে। জহ্লাদগুলো কান পেতে অপেক্ষা করে আছে, রুমালের সঙ্গে হাওয়ার ঘর্ষনের মৃদু খসখস শুনতে পেলেই কান ফাটানো শব্দ, আলোর ঝলকানি... বারুদের গন্ধে ম ম করবে জায়গাটা।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকানো মরতে বসা লোকটার ভয় পাওয়ার কথা, ভয়ে ঠোঁট নীল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ঘেন্না লাগছে। ঘেন্নায় সে নাক কুঁচকোয়। দুটি হত্যার মধ্যবর্তী সময়ে যখন দেওয়ালটা বেওয়ারিশ পড়ে থাকে তখন সম্প্রদায় নির্বিশেষে পথচলতি লোক এসে দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে। অবশিষ্ট শব্দগুলি থেকে উঠে আসা সমষ্টিগত পেচ্ছাপের তীব্র গন্ধে লোকটার নাক জ্বলে যাচ্ছে। সে কুঁকড়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। তার সন্দেহ হচ্ছে যে শব্দগুলোকে সে আজীবন আগলে আছে সেগুলো সত্যি না মিথ্যে! সত্যি হলে আপামর জনতা কি এভাবে তাদের অপমান করতে পারত? পেচ্ছাপ করার সময় থুথু, গয়ের ছেটাতে পারত? স্বপ্নের এই জায়গাটায় হঠাৎ আমার মনে হয় লোকটার কী ফিলিং হচ্ছে আমি কী করে বুঝতে পারছি! এমন তো নয় আমারই আসলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে! পতনোন্মুখ রুমালটা আমার মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঝুলে আছে! ভাবনাটা এলেই অবশ্য আমি ডিনায়াল মোডে ঢুকে পড়ি, নিজেকে প্রবোধ দিই, ধ্যুর, এটা নিছক স্বপ্নই। কারণ আগেও অনেকবার আমি এই স্বপ্নটা দেখেছি।
বেশিরভাগ দিনই এই রকম একটা সময়ে আমার মোবাইলে জলতরঙ্গ বেজে ওঠে, জলতরঙ্গ আমার প্রিয় বাজনা, খুঁজে খুঁজে আমিই ওই বাজনাটার রিং-টোন সেট করে রেখেছি। আসলে এখন আমার অখণ্ড অবসর, এই সব অকাজ করার জন্যে হাতে অঢেল সময়। বাজনাটা শুনতে শুনতে আমি ভিজে পায়ে চেতনার সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসি। চোখ কচলে জেলির মতো চটচটে ঘুম বার করে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিই। এই ঘরটার মেঝে এমনিতেই বেশ নোংরা, সস্তার মোজাইক টালির ফাঁকে পুরু হয়ে ময়লা জমে আছে। চেষ্টা করেও সাফ করা যায় না। ঘুম পড়ে আর বেশি কী নোংরা হবে? বিরক্ত হয়ে ভাবি, এই রহস্যময় ফোনকলটার জন্যেই কোনোদিন আমার লোকটার মৃত্যুদৃশ্য দেখার সুযোগ হয় না। জানা হয় না কে গুলিবিদ্ধ হল, আমি নাকি অন্য কেউ। মোবাইলটা কানের কাছে নিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলি, “কে?” অন্যদিক থেকে যথারীতি কেউ সাড়া দেয় না। দেবার কথাও নয়। কারণ এই নম্বরটা অলোক ছাড়া আর কেউ জানে না। পুরনো সিমটা বার করে অলোক এই নতুন সিমটা আমার মোবাইলে গেঁথে দিয়ে গিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে দেওয়াল খুঁজে আলো জ্বালাই, দেখি অনিতা খাটের ওপর উঠে বসেছে। ওর চোখে মুখে আতঙ্ক, অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কার ফোন?”
আমি হাত ওল্টাই, “ব্ল্যাঙ্ক কল...”
অনিতার চাহনিতে উদ্বেগ লেগে থাকে। বন্ধ দরজার দিকে তাকায়, যেন এখনই বেল বেজে উঠবে। দরজাটা বারোয়ারি বারান্দায় খোলে। বারান্দার লাগোয়া সারি সারি এক কামরার নিম্ন মধ্যবিত্ত বাসস্থান। ঘরের মধ্যে এক কোণে খুপরি কেটে রান্নার প্ল্যাটফর্ম, উলটো দেওয়ালে বাথরুম, পায়খানা... চলতি কথায় এই সমান্তরাল বসবাসের নাম - চ্বল। এখানে থাকার বন্দোবস্ত অলোকই করে দিয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে দেশের পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছে মালুম হয়েছিল এরপর আর পালাবার রাস্তা নেই। এক পা এগোলেই আরব সমুদ্রের কালো জল। সত্যি বলতে কী তখন আমি ভয়ানক ক্লান্ত। অলোকের পুরনো নম্বরটা আমার ফোনে সেভ করা ছিল। একটা চান্স নিয়েছিলাম। একসময় অলোক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, ওকে নিয়ে বনে-বাদাড়ে অনেক ঘুরেছি। সৌম্যদা ওকে নিয়ে এসেছিল। অলোকের বোন লোপামুদ্রার সঙ্গে সৌম্যদার নাকি একটা লুকোচুরি সম্পর্ক ছিল। ওরা দুজনেই কোলকাতার বনেদী ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। কীসের টানে আমাদের দলে ভিড়েছিল কে জানে! বছর পাঁচেক আগে সৌম্যদা মার্ডার হওয়ার পর অলোকও গায়েব হয়ে গেল। শুনেছিলাম ওর বাবা ওকে জোর করে মুম্বাই পাঠিয়ে দিয়েছে, ম্যানেজমেন্ট পড়ার জন্যে। ভাগ্য ভাল অলোক ফোনটা ধরেছিল, আমার গলা শুনে চিনতেও পেরেছিল। বলেছিলাম, ক’দিনের জন্যে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবি? শীত পড়লে চলে যাব। অলোক আমার অবস্থাটা আন্দাজ করেছিল। বলেছিল, তোকে বাড়িতে রাখা মুশকিল। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্য ব্যবস্থা মানে অনিতা... অলোকের রক্ষিতা। ন্যাচারালি অনিতা খাটে শোয়, আমি মেঝেতে, ম্যাট্রেস পেতে। প্রথম প্রথম অনিতা জড়োসড়ো হয়ে থাকত। পরে আমাকে অভ্যেস করে নিয়েছে। সকালে ম্যাট্রেসটা খাটের নিচে গুটিয়ে রাখা হয়, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। বাইরের লোকজনের কাছে আমরা স্বামী-স্ত্রী, সমীর রক্ষিত, অনিতা রক্ষিত। অলোক আমাদের প্রাণের বন্ধু। অলোকের একটা ছোটখাটো ওয়ার্কশপ আছে গোভান্ডিতে, বিশাখা ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ওর বউয়ের নামে, সম্ভবত ওর শ্বশুরের পয়সায় তৈরি, ভালই চলে। বছর খানেক হল অলোক কাছাকাছি একটা গালা নিয়ে অফিসও খুলেছে। অনিতা সেই অফিসে পিওনের কাজ করে। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিল, ইংরিজিতে নাম ঠিকানা পড়তে পারে।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে ভারতে এসেছিল অনিতা। শহরতলীর বেশ্যাপাড়ায় পুলিশের রেড পড়েছিল। পুলিশ অনিতাকে উদ্ধার করে একটা সরকারী শেল্টারে পাঠিয়ে দেয়। অনিতা সেখান থেকে পালায়। কে যেন বলেছিল, একবার মুম্বাই গিয়ে পড়তে পারলে একটা না একটা হিল্লে হয়ে যাবে। সেই শুনে চালু টিকিট কিনে মুম্বাই মেলে চড়ে বসে। দাদরে নেমে পুঁটলি বগলে প্ল্যাটফর্মে বসে ছিল। অলোকের অফিসের ওয়াচম্যান বলরাম গাঁও থেকে ফিরছিল। অনিতার শুকনো মুখ দেখে তার দয়া হয়। সঙ্গে করে চেম্বুর চিতাক্যাম্পে তার খোলিতে নিয়ে আসে। বলরাম লোকটা ভাল হলেও তার ধর্মপত্নী অতি খাণ্ডার। সে অনিতাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে চায়। বলরাম অনিতাকে নিয়ে এসেছিল অলোকের কাছে, যদি সাহাব একটা সুরাহা করে দেয়। মাস দেড়েক আগের ঘটনা, অনিতার গড়ন-পেটন দেখে অলোকের পছন্দ হয়ে যায়। অনিতাকে ঘাটকোপারের সাঁইশ্রদ্ধা চ্বলের এই ঘরটায় এনে তোলে। অলোক আমায় বলেছিল, তুই আপাতত অনিতার ঘরে থাক। আমি অবর-সবরে যাই, একটা পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকলে অনিতার সুবিধে হবে, চ্বলের লোকেরও মুখ বন্ধ থাকবে।
আমাকে আশ্রয় দেবার জন্যে অলোকের কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। হয়তো পুরনো কথা মনে করে তার মন দ্রব হয়ে উঠেছিল। অথবা ভেবেছিল আমি ঝামেলা পাকাতে পারি। টেলিফোন নম্বর যখন পেয়েছি, হুট করে ঠিকানা খুঁজে ওর বাড়িতে হানা দিতে পারি। বউ-বাচ্চা নিয়ে অলোকের সোনার সংসার! পুলিশ যদি একবার আমার নাগাল পায়, কবর খুঁড়ে ওর পূর্বজন্মের লাশ তুলে আনবে। ব্যাপারটা ওর জন্যে খুব সুখকর নাও হতে পারে। আমাকে লুকিয়ে রাখাই ওর পক্ষে নিরাপদ। অলোকের বাঁধা মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকতে হবে শুনে আমার প্রথমে অস্বস্তি হয়েছিল, একটু কিন্তু কিন্তু করেছিলাম। অলোক পাত্তা দেয়নি, মুখে না বললেও হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল, অনিতা সাত ঘাটের জল খাওয়া মেয়েছেলে, তার সতীত্ব নিয়ে অলোকের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। তবু অলোক যখন এখানে আসে খবর না দিয়েই আসে। দরজায় ডুপ্লিকেট চাবির আওয়াজ পেলে বুঝতে পারি অলোক এসেছে। এসেই ঘরের চারদিকে পুলিশের কুকুরের মতো গন্ধ শোঁকে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে দেখে, আলমারির পাল্লা খুলে এটা সেটা নাড়ে, কাচড়ার বালতিতে উঁকি দেয়, মনে হয় কন্ডোমের খোলা প্যাকেট বা ব্যবহৃত কন্ডোম পড়ে আছে কিনা চেক করে। অনিতা গ্যাসে চায়ের জল বসায়। অলোক খাটের ওপর থিতু হয়ে বসে আমার দিকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “যা সমীর, এক প্যাকেট মার্লবোরো নিয়ে আয়। নিচের দোকানটায় পাবি না। একটু দূরে যেতে হবে। এলবিএস মার্গের ওপর... ”
রান্নাঘরের খুপরিতে আচমকা চায়ের কাপে চিনি-গোলা চামচের শব্দ থেমে যায়।
২
সেভাবে দেখতে গেলে অনিতার সঙ্গে আমার স্ট্যাটাসের খুব একটা তফাৎ নেই। আমরা দুজনেই অলোকের আশ্রিত। দুজনেই পুলিশের তাড়া খেয়ে লুকিয়ে আছি। পুলিশ যদি জানতে পারে অনিতা বাংলাদেশী, তাকে ঘেঁটি ধরে বেড়াল ছানার মত পেট্রাপোল বর্ডার পার করে দিয়ে আসবে। আমার অবস্থা আরও সঙ্গিন, মাথার ওপর, জীবিত বা মৃত, সরকার বাহাদুর সামান্য কিছু কাঞ্চনমূল্যও নাকি ধার্য্য করে রেখেছেন। তাই আমরা সাবধানে থাকি, পড়োশীদের সঙ্গে খুব মাখামাখি করি না। যেটুকু না বললে নয়, সেটুকুই কথাবার্তা বলি। মুম্বাইয়ের চ্বলগুলোর নিজস্ব চরিত্র আছে। দিনের বেলায় কারো ঘরের দরজা বন্ধ হয় না। সেটাই সমস্যা। আশপাশের বউ-বাচ্চারা উঁকিঝুঁকি মারে। পাশের ঘরের শান্তাভাবী পোহা বানিয়ে দিয়ে যায়। সিঁড়ির পাশের পাণ্ডেজির চার বছরের নাতিটা হাওয়া-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ‘চল হট’ ‘চল হট’ বলতে বলতে ঘরের মধ্যে পাক মেরে যায়। তিনতলার নাফিসা ঈদের দিন ওড়না ঢেকে সিমুয়ের বাটি নিয়ে আসে।
সপ্তাহের পাঁচটা দিন অনিতা অফিসে যায়। আমি নিষ্কর্মা বসে থাকি, দেওয়ালে ঝোলানো টিভিতে হাবিজাবি সিরিয়াল দেখি। অনিতার অনুপস্থিতিতে শান্তাভাবী, নাফিসারা নাস্তা দেওয়ার অজুহাতে আমাদের খেলনাপাতির সংসার জরিপ করে যায়। দেখে যায় কোথাও কোনও ফাঁক আছে কি না। অনিতা থাকলে অবশ্য গপ্পোগাছা করে দরজা থেকেই বিদেয় করে। মাঝে-মধ্যে আমি গলির বাচ্চা ছেলেগুলোর সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়ি। বৃদ্ধ পাণ্ডেজির প্রেসারের ওষুধ এনে দিই। শান্তাভাবীর সবজি বাজার করে আনি। কাঁহাতক আর এক জানলার ঘরে বন্দি হয়ে বসে থাকা যায়! জানলা বলতে রান্নাঘরের প্ল্যাটফর্মের ওপর গরাদ আটকানো এক ফালি আকাশ। ঘরে যতক্ষণ থাকে সেটুকু নিয়েই অনিতা খুশি থাকে। সকালে খাবার বানিয়ে নিজে ডাব্বা ভরে নিয়ে যায়, আমার জন্যে রান্নাঘরের প্ল্যাটফর্মের ওপর গুছিয়ে রেখে যায়। দরজা-জানলার কথা পাড়লুম কারণ পুলিশ এলে আমাদের পিছনের দরজা বা জানলা দিয়ে পালাবার কোনও উপায় নেই।
পুলিশ আসে, প্রায়ই আসে। চ্বলের লোকজন সবসময় যে সোজা রাস্তায় চলাফেরা করে এমন নয়। তাদের দু-পয়সা উপার্জনের ফন্দিফিকির মাঝে মধ্যেই বৈধতার সীমা পার করে যায়। কী করে যেন পুলিশ খবর পেয়ে যায়, আচমকা হানা দেয়। দু-একটা খব্রি খোঁচড়ও সম্ভবত আশেপাশে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। চ্বলে পুলিশ এলে অনিতা সিঁটিয়ে থাকে। আমাদের ঘরে আসেনি যদিও কোনোদিন, তবু ভয়টা থেকেই যায়। আসতে পারে, যে কোনও দিনই আসতে পারে। এলেই যে তারা আমাদের ধরে ফেলবে এমন নয়। ইদানীং দাড়ি কামানো ছেড়ে দিয়েছি। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মতো লম্বা চুল দাড়ি হয়েছে। হয় তো চিনতে পারবে না, হয়তো সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যাবে। তবু আশঙ্কাটাকে মন থেকে উপড়ে ফেলা যায় না। আমি অনিতাকে সাহস দিই। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চোখে ভয় লেগে থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। বলি, “গলাটা শুকিয়ে গেছে, চা হবে নাকি?”
অনিতা চা বানিয়ে আনে। স্টীলের প্লেটের ওপর দু-কাপ চা সাজিয়ে এনে রাখে খাটের ওপরেই। নামাতে গিয়ে হাত কেঁপে প্লেটের ওপর চা চলকে পড়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি চিনি দিতে ভুলে গেছে। নিজের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে অনিতা জিভ কাটে। অপ্রস্তুত হেসে রান্নাঘর থেকে চিনি আনতে যায়। আমিও হাসি। অনিতা ফিরে এসে বলে, “জানো, ছোটবেলায় গ্রামে আমরা গুড়ের চা খেতাম।”
আমি বলি, “তোমাদের গ্রামের কথা বলো, শুনি।”
অনিতার চোখে টলটল করে ওঠে কাজল দিঘির জল, আম-জাম-জামরুল গাছের ছায়া কাঁপে তিরতির করে। আমি চেয়ে দেখি অনিতার সাদা সিঁথি যেন আলপথ, লিলুয়া বাতাস দুই ভুরুর ধানক্ষেতে ঢেউ তুলছে। অনিতা তাদের গ্রামের গল্প শোনায়, পুকুরে সাঁতার কাটা, এক্কাদোক্কা খেলা, শিল কুড়োনোর চেনা চেনা গল্প। আমি বলি, “তোমার কথায় তো ওপারের টান নেই, একটুও।”
অনিতা বলে, “ছিল প্রথম প্রথম, কলকাতা এসে কেটে গেছে।”
আমি বলি, “কলকাতার কথা থাক।”
অনিতার মা যখন মারা যান তখনও অনিতা নিতান্ত বালিকা। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ওর বাবা শাদি করে ঘরে দু-নম্বর বিবি নিয়ে আসেন। অনিতার বাবা ছিলেন পোশাক-শ্রমিক, তখন বাংলাদেশের পোশাক-শিল্পে লাগাতার ঝামেলা চলছিল। তিনি সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। অনিতা সৎ-মা আর তাঁর প্রেমিক বেলাল চাচার আশনাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছিল। ফ্রকের মধ্যে বুক ঠেলা দিয়ে উঠতে বেলাল চাচার নজর পড়ল অনিতার ওপর। অনিতার সৎ-মা বিষয়টা ভাল চোখে দেখেননি। তিনিই খবরাখবর করে অনিতাকে বেচে দেন সীমান্তের অন্য দিক থেকে আসা এক বিহারি দালালের কাছে। এপার থেকে যেমন গরু চালান হয় ওপার থেকে সদ্য ঋতুমতী হওয়া মেয়ে। অনিতার দুঃখ-গাথা শুনতে পাহাড়ের মাথায় মেঘ ঝুঁকে আসে, মুম্বাইতে বর্ষা নামে। সাবধানী লোকজন ভাঙা ছাদে নীল রঙের প্লাস্টিকের শীট লাগায়। যারা আলো ভালবাসে তাদের কাছে এই শহরের বর্ষা সাংঘাতিক ডিপ্রেসিং। দিনের পর দিন পাঁশুটে মেঘে আকাশ ছেয়ে থাকে। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জল উড়ে এসে ঝাপ্টা দেয় বন্ধ দরজায়, জানলায়। ব্যস্ত মানুষেরা হাঁটুডোবা জল ঠেলে অফিস-কাছারি করে। বেশ কিছুদিন হল অলোক আসে না। ফোনও করে না।
একদিন রাত্তিরে আমাদের ঘরেও পুলিশ আসে। বেঁচে থাকার তাগিদে পলাতক মানুষদের ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকার অভ্যেস তৈরি হয়ে যায়। শুনতে পাই বারান্দায় ভারি বুটের শব্দ আমাদের দোরগোড়ায় এসে থেমেছে। কারা যেন চাপা গলার কথাবার্তা বলছে। রাত্তিরে শোবার সময় অনিতা একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখে। উঠে বসে দেখি অনিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একবার নিচু গলায় ওর নাম ধরে ডাকি। অনিতা সাড়া দেয় না। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে আলোটা নিভিয়ে দিই। অন্ধকারের মতো ছদ্মবেশ দুর্লভ, চেনা মানুষকেও অচেনা লাগে। ম্যাট্রেসটাকে গুটোতে গুটোতে শুনি দরজায় কাদের করাঘাত বাজছে। ম্যাট্রেসটাকে পায়ের ধাক্কায় খাটের নিচে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বেড়ালের মতো লঘু পায়ে খাটে উঠি। পরনের বেনিয়ানটা গা থেকে খুলে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিই। নড়াচড়ায় অনিতা পাশ ফিরে শোয়। আমি সন্তর্পনে অনিতার পাশে শুয়ে দুজনের শরীরের ওপর চাদর টেনে দিই। আমার শরীরের আন্দাজ পেতেই অনিতা ঘুম ভেঙে আঁতকে ওঠে। আমি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে হিস হিস করে বলি, “কথা বোলো না, দরজার বাইরে পুলিশ,” ও বাধা দিতে গিয়েও থেমে যায়।
অনিতার বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল নামিয়ে আমি ব্লাউজের হুকে হাত দিই। অনিতা আপত্তি করে না। দরজায় শব্দটা বাড়তে থাকে, লাথির শব্দ। তাড়াহুড়োয় ব্লাউজের হুক ছিঁড়ে যায়, সস্তার অপলকা ল্যাচ ভেঙে দরজাটাও খুলে যায় হাট হয়ে। আমি আমার শরীর দিয়ে যথাসম্ভব অনিতাকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করি। আমার খোলা পিঠে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ে। ইতরের মতো আলো অনিতার গাল, গলা, নগ্ন কাঁধ চাটে। অনিতা মুখ ফিরিয়ে নেয়। জোরাল আলোয় আমি ওর গালে ব্রনর দাগ দেখতে পাই, ঘাড় ঘুরিয়ে লোকগুলোর মুখ দেখতে পাই না, কেবল কদর্য হাসির শব্দ শুনতে পাই। এই সময় দরজার থেকে ঈশ্বরের মতো ভারি গলায় কেউ ডাকে, ছোড় ইয়ার, রং নাম্বার... এরা নয়, অন্য ঘর। গলাটা যেন কোথায় শুনেছি। হয়তো গত জন্মে। টর্চের পেছনের লোকগুলো নিদারুণ হতাশ হয়। চলে যায়, যাওয়ার সময় কতগুলো অশ্লীল রসিকতা ছুঁড়ে দিয়ে যায়। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আমরা কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকি। যদি তারা ফিরে আসে! বুকের গভীরে টের পাই অনিতা কাঁপছে।
অনিতার শরীরের ওপর থেকে সরে আসতে গিয়ে দেখি ও দু-হাতে আমায় আঁকড়ে ধরে আছে। ওকে আশ্বস্ত করার জন্যে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। অনিতার কাঁপুনি কমে না। ওকে শান্ত হতে বলি। অনিতা আপ্রাণ চেষ্টা করেও শান্ত হতে পারে না। আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আমার বুকের জ্বলে যাওয়া চামড়ায় ওর চোখের জলের ছোঁয়া লাগে। অনেক দিন পর এই পোড়া শরীরটায় জল নিষেক হয়। ইচ্ছের যে বীজগুলো শরীরের মধ্যে লুকিয়ে শুকিয়ে ছিল তাদের অঙ্কুরোদ্গম হয়। তারা ফনফন করে শিকড় ছড়াতে থাকে কোমরের নিচে, তলপেটে, উরুর ভেতরে। বীজের খোলস ফেটে মাটি ফুঁড়ে চারা জন্মায়, ডালপালা মেলে গাছ হয়ে উঠতে চায়। আমার অস্বস্তি হয়। অনিতা কি টের পাচ্ছে না? আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি, অনিতা শোনো, এরকম করে না, লক্ষ্মীটি... অনিতা কথা শোনে না, আমার বুকে মুখ ঘষতে থাকে, অস্ফুট স্বরে উঁ উঁ করে কাঁদতে কাঁদতে পিঠ খামচে ধরে। আমার আর সরে আসার কোনও উপায় থাকে না।
৩
“অলোক তোর পরিতোষ ভট্চাযকে মনে আছে... আইপিএস অফিসার...?”
অলোক চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, “মনে থাকবে না আবার! শালা এঁটুলির মতো পোঁদে লেগেছিল।”
অলোক আজ আমাকে এখনও সিগারেট কিনতে পাঠায়নি। মৌজ করে চা খাচ্ছে। গতকাল রাতে পুলিশ এসেছিল। তারপর থেকে আর বৃষ্টি ধরেনি, ঝরেই চলেছে। দুপুরের হাই টাইডে আখ্খা মুম্বাই ভেসে গেছে, সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেন বন্ধ, মিঠি নদীর জল কূল ছাপিয়ে ঢুকে গেছে দু-ধারের বস্তির ঘরকন্নায়। আমাদের শহর ছেড়ে পালাবার সব রাস্তা ডুবে গেছে। অথচ আমাদের চলে যাওয়াটা জরুরী। কে জানে আবার কখন পুলিশ ফিরে আসে! কাল রাত থেকেই মনটা খুঁত খুঁত করছিল। সকালে উঠেই মনে পড়ে গিয়েছিল গলাটা কার, পরিতোষ ভট্টাচার্য… এক সময় আমাদের কম জ্বালায়নি লোকটা। আদা জল খেয়ে পেছনে পড়ে ছিল। সৌম্যদার মেসোমশাই শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। ওর খুনটা নিয়েও বেশ জল ঘোলা হয়েছিল। ভট্চায ছাঁকনি দিয়ে আমাদের দু-চারজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে আচ্ছা করে রগড়াই দিয়েছিল। কিন্তু বাপেরও বাপ থাকে। কেন কে জানে, আল্টিমেটলি ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যায়। সন্ধের দিকে অলোককে মেসেজ করেছিলাম, একবার দেখা করতে পারবি... আর্জেন্ট। অলোক মেসেজের জবাব দেয়নি। রাত নটায় দরজা ঠেলে ঢুকেছিল। ল্যাচটা কাল থেকে ভাঙা পড়ে আছে। সারানো হয়নি। অলোক ঢোকার সময় বিরক্ত হল, ভাঙল কী করে?
অলোককে সব বললাম। চিন্তা হচ্ছিল, এখানে বেশিদিন থাকা আর নিরাপদ নয়। পরিতোষ ভট্চায লোকটা বিশেষ সুবিধের নয়। অলোক চা খেতে খেতে শুনছিল। বলল, “তোকে চিনতে পারেনি?”
আমি বললাম, “মনে হয় না... কী জানি!”
অলোকের যেন বিশ্বাস হল না। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “আমার কিছু টাকা লাগবে অলোক, হাত খালি একদম।”
অলোক বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কী করবি ভাবছিস?”
আমি বললাম, “কী আর... ঔরঙ্গাবাদের দিকে একবার ঢুঁ মারব, অনেকদিন ওখানকার খবরাখবর পাই না, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”
অলোক জবাব দিল না। টিভির রিমোটটা তুলে টিভি চালিয়ে দিল। শুধু মুম্বাই নয়, অবিশ্রাম বৃষ্টিপাতে রায়গড়, রত্নাগিরি, নাসিক, সাংলি ভেসে গেছে, হাজার হাজার মানুষ ঘর ছাড়া, ভিজে ঝুপসি হয়ে একটা মেয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান দিচ্ছিল। অলোক নিজের মনেই বলল, “ভট্চাজ লোকটা হাড়-হারামী...”
আমি বললাম, “পরিতোষ ভট্চায মুম্বাইতে কী করছে বল তো?”
অলোক হাত ওলটাল, “কে জানে?”
অনিতা প্লেটে পকোড়া ভেজে এনে রাখল। অনিতাকে দেখেই অলোকের নোলা সকসক করে উঠল, মনে পড়ে গেল পকেটে সিগারেট নেই। যথারীতি পার্স বার বলল, “সমীর, যাবি একবার...,” আমি অনিতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখ মুম্বাইয়ের আকাশের থেকেও থমথমে। সারাদিন কী খুশি ছিল মেয়েটা! দুপুরবেলা রান্নাঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে দু-এক কলি গান গাইতেও শুনেছি। এখন দু-চোখে মিনতি - যেও না। অন্তত আজকের দিনটার জন্য কোথাও যেও না।
আমি অলোককে বললাম, “তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে রে বাইরে... বেরোব কী করে?”
অলোক সামান্য থমকাল, বলল, “ছাতা নিয়ে যা।”
আমি বললাম, “না, আজ না...”
এর আগে কোনোদিন অলোকের মুখের ওপর না বলিনি। অলোক আশ্চর্য হল, “না মানে...?”
আমি একটু রুক্ষ ভাবে বললাম, “না, মানে না। তোর তো অনেক চেনাজানা, পারলে তুই আজ রাতেই গাড়ির বন্দোবস্ত কর। আর হ্যাঁ... অনিতাও আমার সঙ্গে যাবে।”
অলোকের বুঝতে একটু সময় লাগল, তারপর গলা তুলে বলল, “সমীর, তুই কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছিস। একটা দু-পয়সার মেয়েছেলের জন্যে...”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “কীসের বাড়াবাড়ি? আমি ধরা পড়লে তুইও কিন্তু ফাঁসবি।”
অলোকের মুখ থেকে আস্তে আস্তে মুখোশ খসে পড়ছিল, ভুরু কুঁচকে বলল, “ভয় দেখাচ্ছিস?”
আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, “সৌম্যদাকে কারা খুন করেছিল তুই আমার থেকে ভাল জানিস অলোক। আমি তো চুনোপুঁটি, তোর কি মনে হয় শুধু আমাকে খুঁজতে পরিতোষ ভট্চায মুম্বাই এসেছে?”
অলোক সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “আমি কী করে জানব? সৌম্যদার খুনের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?”
আমি বললাম, “সাবধানে থাকা ভাল, কেঁচো খুঁড়তে সাপ না ফণা তোলে! লোপা এখন কোথায় থাকে রে... অস্ট্রেলিয়ায়? ওর হাজব্যান্ডের কীসের যেন বিজনেস...? কেমন আছে ওরা?”
অলোক ফুঁসে উঠল, “লোপা...? তুই কি আমাকে ব্ল্যাকমেল করবি ভেবেছিস? এত নিচে নেমে গেছিস?”
আমি ওকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলাম, “তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি সবার ভালর জন্যেই...”
অলোক ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আমার ভাল তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে।”
আমি হাসলাম, বললাম, “ছাড়, তোকে গাড়ির বন্দোবস্ত করতে হবে না। আমি আর অনিতা না-হয় এখানেই থাকব, কোথাও যাব না। তুই এখন বাড়ি যা। তোর বউ ছেলে চিন্তা করবে। ওরা বোধ হয় জানে না তুই এখানে এসেছিস।”
অলোকের চোখ জ্বলে উঠল ধক ধক করে, বলল, “আমার বউ-ছেলেকে এসবের বাইরে রাখ সমীর। ওরা যদি ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে পারে আমি কিন্তু তোকে ছাড়ব না।”
আমি শান্ত গলায় বললাম, “মাথা গরম করিস না অলোক, আমি কাউকে কিছু বলতে যাচ্ছি না। রাত হয়ে গেছে অনেক, বাড়ি যা। কী করা যায় কাল না-হয় ভেবেচিন্তে দেখা যাবে।”
আমি ভাল মনেই বলেছিলাম কথাটা, কিন্তু অলোকের দাঁত-নখ বেরিয়ে এল, চিৎকার করে বলল, “আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছিস? শোন সমীর, তোর মতো ফতো বিপ্লবী অনেক দেখেছি। শালা, মুরোদ নেই এক কড়ার, বড় বড় কথা! ঘরটা যে আমার নামে ভাড়া নেওয়া ভুলে গেছিস? আমি নয়, তুই যাবি... এই মুহূর্তে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবি, জাস্ট গেট আউট...”
অলোকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার সময় অনিতা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সম্ভবত নিজেকেই দোষারোপ করছিল। ভাবতে পারেনি ঘটনাটা এমন খারাপ দিকে গড়িয়ে যাবে। অলোককে শান্ত করার জন্য অনিতা বোধ হয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, দরজায় কাকে দেখে থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম শান্তাভাবী, চেঁচামেচি শুনে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। শান্তাভাবী অলোককে আগে দেখেছে, মুখ চেনে, বলল, “ভাউ, কাহেকো চিল্লাম-চিল্লি কর রহে হো? রাত বহোত হো গয়া, বারিষ ভি হ্যায়, অব তুম যাও। সহীমে ঘরবালে শোচতে হোঙ্গে...।”
শান্তাভাবীর আশেপাশে আরো দু-চারটে চেনা মুখ জড়ো হচ্ছিল, পাণ্ডেজী, বলবন্ত, হাসেমচাচা, হাসমুখ ভাই... সবাই এই চ্বলের বাসিন্দা। রোগা পটকা এক বাঙালি বাবু আর তার খুবসুরৎ অওরাত ঝামেলায় পড়েছে খবর পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন পালোয়ান গোছের লোক এগিয়ে এসে বলে, “ক্যা সমীরবাবু, কোই পরেশানি?” লোকটাকে আমি চিনি না, কিন্তু সে আমায় চেনে। অলোক ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগোল। আমি পিছন থেকে বললাম, “সাবধানে গাড়ি চালাস, অলোক।”
অলোক পেছন ফিরে আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে রাগের বদলে আশঙ্কার ছায়া, একটা অনিশ্চিত ভাব। এতক্ষণ যে রোয়াব দেখাচ্ছিল তা যেন জোলো হাওয়ায় মিইয়ে গেছে। অলোক ভাবতেই পারেনি চ্বলের লোকেরা একটা উদোমাদা ছোকরার পাশে এসে দাঁড়াবে। খোলা দরজা দিয়ে দেখলাম, অলোক বারান্দা পার হয়ে হেরো মানুষের মতো এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। তার যাওয়া দেখে মনে হল না সে আর কোনওদিন ফিরবে।
সবাই এক-এক করে চলে যাচ্ছিল। পাণ্ডেজির নাতিটা চোখ বড় বড় করে মুখের মধ্যে বুড়ো আঙুল পুরে দাঁড়িয়েছিল। অনিতা তার গাল টিপে আদর করে দুটো নারকোল নাড়ু দিল। কখন বানিয়ে রেখেছিল কে জানে! একটা কৌটো খুলে নাফিসার কোলের ছেলেটার হাতে একটা বিস্কুট দিল। শান্তাভাবীকে ফিসফিস করে ডেকে বলল, “ভাবী খিচ্ড়ি বানায়ি থি আজ, বাঙ্গালি লোগোকা খিচ্ড়ি, আলু ফুলগোবি ডালকে, লেকে যাও থোড়াসা।”
ঘর ফাঁকা হতে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আমার বুকের ওপর এসে আছড়ে পড়ল অনিতা। মানুষের চোখের ভেতর এত জলও থাকতে পারে! কে জানে? আমি নিতান্ত রুখা-শুখা মানুষ, আজীবন পাথর ডিঙনো অভ্যেস, জলের রকম-সকম বুঝি না। অনিতা ফুলে ফুলে কাঁদছিল। আমি ওকে সামলাতে পারছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছিল ওর, মনে হচ্ছিল অসুস্থ হয়ে পড়বে। শান্ত করার জন্যে বললাম, “খিদে পেয়েছে, খেতে দেবে না?”
*
ঘরের মেঝেয় আসন পিঁড়ি হয়ে বসে অনিতার রান্না করা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর টোম্যাটোর চাটনি খেতে খেতে অলোকের কথা ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আজ থেকে বেচারার পালানো শুরু হল। আমি নিশ্চিত এখন থেকে বধ্যভূমির স্বপ্নটা আমার মতো ওর ঘুমের মধ্যেও ঘুরে ফিরে আসবে। পরিতোষ ভট্চাযের হাত থেকে কখন রুমালটা খসে পড়ে সেই দুশ্চিন্তায় ওর চোখের নিচে কালি পড়ে যাবে। মাঝ রাতে মোবাইলে বেনামি রিং টোন শুনে বিছানায় উঠে বসবে। ওর বউ ঘুম ভেঙে ওর দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকবে। ওর ছেলে ওর ঘামে ভেজা হাতের তালু হাতের মধ্যে নিয়ে ঝাঁকি দিয়ে বলবে, বাবা কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছ? অলোক জবাব দিতে পারবে না। আসলে সব মানুষকেই কোনও না কোনও দিন ওই অপার্থিব বধ্যভূমিতে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে বুক পেতে দাঁড়াতে হয়। তখন দেওয়ালের গায়ে আগলে রাখা ভাঙাচোরা শব্দগুলোই নির্ধারণ করে দেয় ঘোর বর্ষার রাতে মানুষটা ভালবাসা মেখে মেখে খিচুড়ি খাবে, না খোলা রাস্তায় ভূতের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকবে।
হঠাৎ মনে হল, সাঁইশ্রদ্ধা চ্বলের এই ঘরটায় অনিতার সঙ্গে পার্মানেন্টলি থেকে গেলে কেমন হয়!
অলংকরণঃ কল্লোল রায়
ফেসবুক মন্তব্য