হিমালয়ের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে হিমাচল প্রদেশ ভ্রমণ হয়েছে দুবার। কিন্তু কখনও কিন্নর যাওয়া হয়ে ওঠেনি বলে খেদ ছিল। তাই গত বছর গিয়েছিলাম কিন্নর। সেই টেনেছে হয়তো!
হিমাচল প্রদেশের একটি প্রশাসনিক জেলা কিন্নর। বাণিজ্যকরণের চরম আধুনিক স্পর্শ দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামের বহিরঙ্গে অনেক চটক হয়তো এনেছে কিন্তু অন্তরঙ্গ সেই আবহমান দারিদ্র্য ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পায় নি। এখনো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিন্নর, কিন্নরীরা কঠোর পরিশ্রম করে জীবন যাপন করে। অনন্য প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অকৃপণ দানে ঋদ্ধ দেবভূমি কিন্নর। আর সেই ঐশ্বর্যের পরশ পেয়েই খুশি সেখানকার গ্রামবাসীরা। তাই তো খিদেক্লিষ্ট, দারিদ্র্যে দীর্ণ কিন্নর কিন্নরীদের মুখেও যেন অমলিন প্রকৃতির স্বর্গশোভা। বিরল সৌন্দর্যের দেশ এই কিন্নর গ্রাম, সত্যি চোখ জুড়িয়ে যায় এর সীমাহীন সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি দেখে।
বরফের আস্তরণে ঢাকা কিন্নর কৈলাসের চূড়া। তার পায়ের নীচে কুলু কুলু সুরে গান গেয়ে চলেছে নৃত্যরতা শতদ্রু নদী। আর তার স্ফটিক স্বচ্ছ জলে ঐন্দ্রজালিক মায়ায় বিম্বিত হয়ে চলেছে চলমান সবুজ অরণ্যানী।
"কল্পা" কিন্নরের সদর শহর রিকংপিওর ওপরে একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম বা একটি ছোট্ট রূপকথার শহর বলা যায়। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী, শৈলশহর সিমলা থেকে গাড়ি করে হিমালয়ের হৃদয়দেশ পরিক্রমন করে আমাদের যাত্রা শুরু হল কল্পা -কিন্নরের পথে৷।
মোহিনী কল্পা। নিখিল বিশ্বের আদিতম সভ্যতাকে ছোঁয়ার অভীপ্সায়, ছুটে চলা অবিরাম বিরতিহীন লয়ে। হাড়-হিম শীতলতার শিহরণ মেখে হিমাচলের স্পন্দন ছোঁব বলে; শৈত্যের তীব্রতা ও কম্পনের হিহি-তেও থাকে অনির্বচনীয় মাদকতা।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথের খাঁজে খাঁজে দেবদারু পাইনের গহীন আতিশয্য। কখনো জনপদ ছবি হয়ে আছে উপত্যকার গালিচায়। সবুজ ক্ষেতির পেলব মোটিফ বুনেছে কিন্নরবাসী। পাকদণ্ডীর বাঁকে বাঁকে বুনো গোলাপ আঁকছে আগুন, মোহনীয় তার লালিমা। উঁকি মারছে আপেল, চেরী, আখরোট, খোবানি গাছ, পাগল হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে তারা অভ্যর্থনাপ্রবণ। আপেল ফলনে কল্পার জুড়ি নেই। আপেল এই গ্রামেরঅর্থকরী ফসল।
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের শরীরগুলো যখন অস্তরাগের রঙ মাখতে শুরু করেছে সবে, সুনীল আকাশের বুক চিরে কিন্নর কৈলাসের চূড়ায় তখন ইন্দ্রধনু সাত রঙের ফোয়ারা খুলে দিয়েছে। এই অনাবিল কল্পরাজ্যে পা ফেলেই স্তব্ধবাক, হারিয়ে ফেলেছি মুখের ভাষা। হঠাৎ জমাট মেঘগুলো সরে যেতেই পাহাড়চূড়াতে গৌরীপাটের আদল নিয়ে কড়ে আঙুলের মত শিবলিঙ্গ প্রকট হয়ে উঠল। আশ্চর্য, লিঙ্গের মাথার দিকটা নিকষ কালো, যদিও শরীরটা তাঁর শ্বেত হিমানী। ওদিকে শৈব ট্যুরিষ্টদের গগনভেদী ধর্মপ্রাণ উচ্চারণ --"জয় মহাদেবের জয়", ''জয় আদিনাথের জয়''।
পালকের মতো হালকা, পেলব মেঘগুলো পায়চারি করতে করতে, দুভাগে এমনভাবে বিন্যস্ত হলো যেন মুখোমুখী নারী পুরুষের অবয়ব। নেপথ্য দৃশ্যকল্পে চিরন্তন দুই প্রেমী হর-পার্বতী দৃশ্যমান হলেন ভক্তদের ধ্যানে-জ্ঞানে। বিরল মাধুরীতে বিভোল আমার অবশ চোখদুটো। সৌন্দর্যমুগ্ধ চোখে জরিপ করে নেই গোটা ছবিটার নান্দনিকতার প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফুর্ততা। নীল আকাশে সাদা মেঘে ইতস্তত বিচরণের ভঙ্গীতে কখনো উদ্ভাসিত পক্ষীরাজ ঘোড়ার ছুটন্ত দুটো ডানা!
জমাট নীল আকাশে, মেঘপালকের তুলি যেমন ছবি আঁকছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিরেট পাথরের বিন্যাসে অনায়াস কল্পনায় এক নারী, এক পুরুষের অবয়ব যেন অর্ধনারীশ্বর হয়ে সন্নিবিষ্ট হয়ে ওঠে। কখনো তা সৌন্দর্যমুগ্ধ চোখে, কখনো বা ভক্তিআপ্লুত মনে। যেন রঙ,তুলি নিয়ে নিবিষ্ট মনে নানা ছবি এঁকে চলেছেন কোন অদৃশ্য শিল্পী! আর বিশ্বস্রষ্টা তাঁর ঝুলি উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন সবটুকু সৌন্দর্য হিমাচলের কিন্নর গ্রামে।
আর এই কিন্নরের কল্পলোক হলো "কল্পা"। মিষ্টি নামের গ্রাম, খরস্রোতা নদী শতদ্রুর সাথে তার নিত্য আলাপচারিতা; প্রথম দর্শনেই এর সাথে প্রেমে না পড়ে উপায় নেই; সেই "নদীর নামটি অঞ্জনা, গ্রামের নামটি খঞ্জনা" র মতো এক আবেশী মুগ্ধতার সম্মোহন!
শতদ্রু নদী আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এই কিন্নরী গ্রামকে। নীল,সবুজ আর সাদা রঙের অনন্য রসায়নে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে গ্রামের উঠোনে! দেবভূমি নাম কি এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের জন্যই? না জনশ্রুতি মতো শিবের আবাসস্থল বলে? কি জানি! তবে শিবলিঙ্গম চূড়ার কিছু দূরেই বরফের চাদর জড়িয়ে আরেক শৃঙ্গরাণী আছেন। তিনি পার্বতী পিক বলে নামাঙ্কিতা।
এটাও জনশ্রুতি, দেবী নাকি শিবপূজো করতে বরফের সিঁড়ি ভাঙেন অবলীলায়। বিশ্বাসযোগ্যতাকে সরিয়ে রেখে বলা যায় বড় রোমাণ্টিক এই দেবভূমি। ভারি রোমান্টিক, পৌরাণিক এই যুগলপ্রেমিক।
শুধু ধ্যান আর গাঁজাতে মনোনিবেশ না করে নির্ভেজাল কবিতা লেখার অনন্য পরিবেশ কিন্তু এই কল্পা। কালিদাস তো দিব্যি এক মেঘকে দূত করে পাঠিয়ে দিলেন অলকায় বিরহিনী প্রিয়ার কাছে। শিবলিঙ্গম চূড়া ৭৯ফুট উঁচু একশিলা স্তম্ভ, আর মুহূর্তে মুহূর্তে এর রঙ-বদলে এক অপার্থিব সৌন্দর্যসৃষ্টির উৎস। এই শিলা বৌদ্ধদের কাছে যেমন পবিত্র তেমনই পবিত্র হিন্দুদের কাছে। কল্পাতে বৌদ্ধ ও হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস। শুনলাম পার্বতী পিকে সবুজ মখমলী উপত্যকায় রয়েছে রূপকথার রাজ্যের মতো কসোলি গ্রাম। তার কোল ছুঁয়ে বহতা পার্বতী নদী।
এই সফরে বঞ্চিত হলাম আমরা পার্বতী উপত্যকার সৌন্দর্য থেকে। কল্পার কাছেই তো, তাই কষ্টকল্পনা করতে হল না। সহজেই মনের চোখে সেই নয়নাভিরাম শোভা দেখে নিতে পারলাম। আকাশের নীল সামিয়ানায় রোদ ঝলমল সাদা মেঘের মিছিল ভেদ করে বরফমোড়া শৃঙ্গরাজেরা আর পাকদণ্ডীর চড়াই উৎরাই নিপুণ হাতে নিয়ত ছবি আঁকে কল্পার ক্যানভাসে।
কিন্নরী কল্পা নিজেই যেন অনাবিল, স্বতস্ফূর্ত এক কবিতা। সমাহিত প্রেমের কবিতা। মনে হলো এই বোধহয় প্রথম কেউ আমার জন্য অজস্র কবিতা লিখে রেখেছে আকাশের অনন্ত নীলে, মেঘের শ্বেত পালঙ্কে, সবুজ অরণ্য বা বরফের চাদরে। ইচ্ছে হল বরফ ছুঁয়ে শীতল করে নিই বুকের যাবতীয় পুরানো দগদগে ক্ষত।
বিদায় সুন্দরী কল্পা, এরকমই অনাঘ্রাতা, অপাপবিদ্ধা থেকো তুমি। এ জন্মে হয়তো শারীরিকভাবে নয়, তবু হয়তো দেখা হবে আবার কোনো এক স্বপ্নিল ভোরে!
ফেসবুক মন্তব্য