মিশ্র সংস্কৃতির দেশ
ভারতবর্ষে সবসময়ই মিথ,
পুরাণ এবং ইতিহাস হাত
ধরাধরি করে চলেছে। তার
ফলে তৈরি হয়েছে এক লোকজ
ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয়
আচার অনুষ্ঠান পালনের
রীতিনীতি।
অঞ্চলভিত্তিকভাবে
জরিপ করলে দেখা যাবে,
একই দেবতা বিভিন্ন নামে
ও রূপে পূজিত হয়ে আসছেন
বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু
মূল ভাবনার জায়গাটা একই
থেকে যাচ্ছে। আরেকটু
স্পষ্ট করে বললে বলা
যায়, এক একটি জায়গার
ভৌগলিক অবস্থানের
কারণে আবহাওয়া ও
জলবায়ুর তারতম্য ঘটে
যায়। যার ফলে সেই
নির্দিষ্ট জায়গার
মানুষ একধরনের পোশাক বা
খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত
হয়ে পড়েন। ঠিক সেরকম
তাঁদের ধর্মীয়
বিশ্বাসেরও মূল
জায়গাটা একই থেকে
গেলেও, আচার অনুষ্ঠান
পালনের নিয়মগুলির তফাৎ
হয়ে যায়। ইতিহাসের দিকে
তাকালে আমরা দেখতে পাব,
প্রকৃতির নানা
বিপর্যয়ের সঙ্গে এঁটে
উঠতে না পেরে আদিম
মানুষ একসময় প্রকৃতির
বিভিন্ন উপাদানের পুজো
করা শুরু করেছিল। এভাবে
জল, বায়ু, আগুন প্রভৃতির
পুজোর সূচনা হয়। আবার
পুরাণে বর্ণিত
দেবদেবীর পুজো করা
ছাড়াও ধীরে ধীরে
মানুষের মধ্যে স্থানীয়
নানা প্রতিকূল অবস্থার
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
তৈরি হয় এক সমান্তরাল
পূজা-অর্চনার ধারা।
যেমন সুন্দরবন অঞ্চলে
জল এবং বিভিন্ন বণ্য
জন্তুর আক্রমণ থেকে
বাঁচার জন্য বনবিবি ও
দক্ষিণরায়ের পুজোর
প্রচলন। তেমনি বণ্য
জন্তু, শ্বাপদ,
বিপজ্জনক
কীটপতঙ্গসংকুল
উত্তরবঙ্গের তরাই
অঞ্চলের বিভিন্ন
জাতি-জনজাতির মধ্যেও
এইসবের থেকে পরিত্রাণ
পেতে এবং বন্যা, ধ্বস,
মহামারীর হাত থেকে
রক্ষা পেতে নানা ধরনের
দেবতা, অপদেবতা এবং
উপদেবতার ভাবনা তৈরি
হয়েছে।
উত্তরবঙ্গের এক
সুপ্রাচীন লোকদেবতা
হলেন মাশান। কিছু গবেষক
বলেছেন, মানুষের
ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত
কল্যাণ কামনায় এই
দেবতার পুজো করা হয়।
আবার কেউ বলছেন, এই
দেবতা দেখতে করাল-দর্শন
ও প্রকৃতিতে
ক্ষতিকারক। আসল কথা হল,
একসময় জীবিকার কারণে এই
অঞ্চলের মানুষদের
তরাই-ডুয়ার্সের ঘন
জঙ্গলের ভেতরে যেতেই
হত। সেই গভীর অরণ্যে
সবসময় বিশুদ্ধ জল পাওয়া
যেত না, বাধ্য হয়ে দূষিত
জল খেয়ে পেটে ব্যথায়, পথ
হারিয়ে ফেলে বা বনের
হিংস্র জন্তু-জানোয়ার,
সাপখোপের কামড়ে প্রাণ
হারাতেন প্রচুর লোক। তা
ছাড়াও বন্যা,
মহামারিতেও কত কত
মানুষের প্রাণ যেত।
এইসব বিপদ-আপদ আর
দৈনন্দিন জীবনে নানা
বাধা-বিপত্তির হাত থেকে
রক্ষা পেতে স্থানীয়
মানুষেরা মাশানের পুজো
করা শুরু করেন। কিন্তু,
যাই হোক না কেন, এর সঙ্গে
জড়িয়ে আছে সাধারণ
মানুষের আশা আকাঙ্খা ও
আবেগ, সবচাইতে বড় কথা হল,
যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের
মানুষ এই লোকদেবতার
পুজো করে এসেছেন এই
বিশ্বাস নিয়ে যে,
সমস্তরকম বিপদআপদ থেকে
তিনি মানুষকে রক্ষা
করবেন,পথ দেখাবেন।
খুব
অদ্ভুতভাবেই ষোলো বা
আঠেরো রকমের মাশানের
মধ্যে সকলেই পুরুষ।
এঁরা দিন বা রাতের যে
কোনও সময় নারী পুরুষ
নির্বিশেষে মানুষের
ওপর ভর করেন। প্রায় পাল
রাজাদের সময় থেকে
মাশানের ভাবনার সূত্র
পাওয়া যায়।
উত্তরবঙ্গের নানা
অঞ্চল, সিকিম, মেঘালয়
এবং আসাম ছাড়াও
বৌদ্ধ-ধর্ম প্রভাবিত
শ্রীলংকা, নেপাল আর
বাংলাদেশের কিছু
অঞ্চলে মাশানের আরাধনা
প্রচলিত রয়েছে। শোলার
তৈরি মাশানের মূর্তি
আকৃতিতে জ্যামিতিক।
প্রাচীন অঙ্কনশৈলীর
ছোঁয়া মাশানের গঠনের
মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।
এর থেকে এই দেবতার
অস্তিত্বের প্রাচীনতা
সম্পর্কে একটা ধারণা
করা যায়। উত্তরবঙ্গের
জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং,
কোচবিহার, উত্তর ও
দক্ষিণ দিনাজপুর,
মালদা, আলিপুরদুয়ার সব
জায়গাতেই এই পুজো হয়।
তবে স্থানভেদে
মাশানদেবতার মূর্তিও
বদলে বদলে যায়। কোথাও
শোলার মূর্তি, কোথাও
আবার মাটির। পুজোর
নির্দিষ্ট কোনোও
মন্ত্র নেই। যজমান
নিজেই পুজোর অধিকারী।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভর
করা মানুষকে উদ্ধার
করার জন্য একজন দেবংশী
বিভিন্ন আচার
অনুষ্ঠানের মাধ্যমে
মাশানদেবতাকে তুষ্ট
করেন। স্থানীয়
মানুষদের বিশ্বাস,
বিভিন্ন রোগব্যাধি,
জন্তু-জানোয়ার, শ্বাপদ
ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ
এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ
এই মাশান কুপিত হলেই
ঘটে। সময়ের সঙ্গে
মাশানের ভাবনায় ও
আকৃতিতে কিন্তু বিশেষ
রূপান্তর ঘটেনি। এই
সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে
একই রকম রয়ে গেছে।
সাধারণভাবে জলপাইগুড়ি
জেলায় মাশানের শোলার
মূর্তি, কোচবিহারে
মাটির এবং দিনাজপুর
অঞ্চলে মাশানের মুখোশ
দেখা যায়। আবার নেপালে
মাশানের কোনো মূর্তি
নেই, সেখানে বিমূর্ত
রূপের পুজো হয়। তাকে
বলে ‘থাপানা’।
‘থাপানা’ আসলে এক মাটির
ঢিপি। অধ্যাপক-গবেষক ডঃ
দীপক রায় তাঁর প্রবন্ধে
লিখেছেন, সব জায়গার
মাশান মিলিয়ে
একশোছাব্বিশ ধরনের
মাশানের খোঁজ পাওয়া
যায়। এই নিবন্ধে আমরা
দেখে নেব মাশানের ভাবনা
কোথা থেকে এসেছে।
বজ্রযানী বা তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্ম একসময়
ভারতবর্ষে বিপুল
জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
অনার্য জাতি-জনজাতির
লৌকিক ধর্ম ও
লোকবিশ্বাসের সঙ্গে
তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্মের
সংমিশ্রণেই এই মাশানের
ভাবনা গড়ে ওঠে এবং আজও
গ্রামীণ সমাজে একইভাবে
এই লোকবিশ্বাসের ধারা
বয়ে চলেছে।
মাশানের পুজোর উপাচার
খুবই সামান্য। শুয়োর,
পায়রা, হাঁস, মাছ, ডিম,
চাল, দই, চিঁড়ে, ফলমূল
ইত্যাদি দিয়েই পুজো
সারা হয়। স্থানীয়
লোকবিশ্বাস, কাউকে
মাশান ভর করলে সেই
মানুষ উনুনের পোড়া
মাটি, কাঠ কয়লা, কুমোর
বাড়ির ভাঙাচোরা পোড়ানো
বাসন, পোড়া চাল এসব খেতে
শুরু করে। রান্না করা
খাবার আর খেতে চায় না।
এই খাদ্যাভ্যাস তাকে
ধীরে ধীরে দুর্বল করে
ফেলে এবং একসময় মানুষটি
মারা যায়। এইসময় একজন
দেবংশী বা ওঝা ডাকার
প্রচলন আছে। তিনি এলে
তার সামনে আক্রান্ত
মানুষটিকে একটি কাঠের
পিঁড়িতে বসিয়ে সর্ষে
ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন
মন্ত্র বলে ঝাড়ানো হয়।
তিনবার এই প্রক্রিয়া
চালানোর পর সেই
সর্ষেবীজগুলি একটি
বাঁশের চোঙায় ভরে
মুখবন্ধ অবস্থায় সেই
চোঙটি দূরের জঙ্গলে
ফেলে আসা হয়। মাশান এই
সর্ষেবীজের মধ্যে ঢুকে
যান বলে স্থানীয়
বিশ্বাস। এতেও কাজ না
হলে একটি পুজোর আয়োজন
করা হয়। শোলা বা মাটি
দিয়ে মাশানের মূর্তি
তৈরি করে স্থাপন করা
হয়। পুজোর উপাদান
হিসেবে পোড়া মাটি,
কাঠকয়লা, পোড়া মাছ, মাংস,
ডিম ও চাল উৎসর্গ করা
হয়। পুজোর উপাদানগুলি
একটি কলাপাতায় সাজানো
থাকে। মূর্তি এবং পুজোর
উপাচারগুলি পুজোর পর ওই
কলাপাতায় শক্ত করে
বেঁধে দূরবর্তী জঙ্গলে
নিক্ষেপ করা হয়।
বিশ্বাস আছে যে এরপর
মাশান ভর হওয়া
ব্যক্তিকে ছেড়ে যান আর
মানুষটি সম্পুর্ণ
সুস্থ হয়ে যায়। পুজো
করতে আসার আগে ওঝা
নিজেকে বাঁচানোর জন্য
কিছু মন্ত্র পড়ে বন্ধন
দেন{(বন করে)২, সান্যাল,
পৃঃ ১৬৩}, যাতে করে মাশান
তার কোনও ক্ষতি করতে না
পারেন।
পশ্চিম দিনাজপুর জেলায়
রাজবংশী অধ্যুষিত
গ্রামগুলিতে বহু
জায়গায় মাশান ঠাকুরের
পাট দেখা যায়। এখানে
এবং কোচবিহার জেলায়
মাশানকে ঠাকুর বলা হয়।
যদিও পৌরাণিক কোনও
দেবদেবীর সঙ্গে এর
প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই।
তবে এক জায়গায় এসে
পুরাণ ও লোকবিশ্বাস
মিলেমিশে গেছে।
কোচবিহার জেলার
দিনহাটা থানার
আলোকঝাড়ি গ্রামে
মাশানের একটি বিখ্যাত
পাট আছে। এটিই একমাত্র
পাট, যেখানে পুজোয়
সংস্কৃত মন্ত্র
ব্যবহার করা হয়।
মন্ত্রটি হল,
“নমঃ কুবেরং ধনদং খড়গং
দ্বিভুজ পীতবাসস
প্রসন্নবদন দেব
দক্ষগুহ্যক সেবিতঃ”
এখানে স্পষ্ট যে,
মাশানকে কুবের বলে
সম্বোধন করা হচ্ছে।
আবার কুবেরের অপর নাম
যক্ষ। এই যক্ষ থেকেই
আবার রাজবংশীদের
যখাঠাকুরের ভাবনা
এসেছে। এই সমাজের
ধারণায় যখাঠাকুরই শিব।
অতএব, আমররা এই
সিদ্ধান্তে আসতে পারি
যে, মাশান শিবেরই এক
লৌকিক রূপ। ডঃ
গিরিজাশঙ্কর রায় তাঁর
গবেষণাপত্রে বলেছেন,
“শ্মশান-মশান একটি
ব্যাপক প্রচলিত শব্দ।
সম্ভবত মশানে যে দেবতা
বিরাজ করেন সেই দেবতাই
পরবর্তীকালে মাশান
হইয়াছেন, অর্থাৎ
শ্মশানচারী শিবই
মাশানের মূলে
রহিয়াছেন।“(৩,পৃ ২৯)
মাশানের উদ্ভব
সম্পর্কে ডঃ
চারুচন্দ্র সান্যালের
বইতে{২(পৃঃ ১৬২)} একটি
আকর্ষক মিথ বা লোকগল্প
বলা হয়েছে। একদিন দেবী
কালী নদীতে একা একা
স্নান করতে গিয়েছিলেন,
সেইসময় আকস্মিকভাবে
ধর্মঠাকুর আবির্ভুত
হন। তাঁদের মিলনে
উদ্ভুত সন্তানই হল
মাশান। তার নাম রাখা হয়
পিচলা মাশান বা মাশনা।
তার রূপ করালদর্শন এবং
প্রকৃতিতে ক্ষতিকারক।
আদিতে মাশানের বাহন
হিসেবে শুধু ঘোড়াকেই
কল্পনা করা হত। সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে এবং সম্ভবত
মাশানশিল্পীদের
কল্পনার হাত ধরে আরও
বিভিন্ন রকমের বাহনের
কথা আমরা জানতে পারি।
এক একটি নির্দিষ্ট
মাশান কুপিত হলে
মানুষের জীবনে একেক রকম
দুর্যোগ নেমে আসে। যাই
হোক আপাতত প্রকৃতি
অনুসারে দেখে নেওয়া যাক
মাশানের বিভিন্ন
রূপগুলি। এক্ষেত্রে
আমরা গিরিজাশঙ্কর
রায়ের দেওয়া তালিকা
অনুসরণ করব।{৩(পৃঃ ২৯)}
১। বাড়ীকা মাশান – এই
মাশান বাড়ির কাছাকাছি
জঙ্গলে বা বাঁশবনে বাস
করেন। বাড়ির লোকেরা
কোনও দোষ করলে তাদের
ওপর ভর করেন।
২। তিশিলা মাশান – জলে
বাস করেন। দুপুরে বা
সন্ধ্যায় একলা মানুষকে
পেলে ভর করেন।
৩। ঘাটিয়া মাশান – নদী
বা পুকুরের ঘাটে থাকেন
এবং কাজেকর্মে তিশিলা
মাশানের মতো।
৪। ছুঁচিয়া মাশান –
বাড়ি থেকে দূরে মাঠে
বাস করেন। ভর
সন্ধ্যাবেলা বা বেশি
রাতে পথিককে ভর করেন।
৫। চলান মাশান – পথের
ধারে গাছে থাকেন। গাছের
তলা দিয়ে কেউ গেলে তার
ওপর ভর করেন।
৬। বহিতা মাশান – ভেলা
নষ্ট হয়ে গেলে সেই
কলাগাছ যখন জলে ভেসে
বেড়ায়, সেই গাছে থাকেন।
কেউ ভুল করে সেই কলাগাছ
ছুঁয়ে ফেললেই তাকে ভর
করেন।
৭। কাল মাশান – এই
মাশানের বাস শ্মশানে।
কেউ সন্ধ্যেবেলায় বা
রাতে শ্মশানের পাশ দিয়ে
গেলে তার ওপর ভর করেন।
৮। কুহুলীয়া মাশান –
উত্তরবঙ্গের
কথ্যভাষায় কোকিলের নাম
কুহুলী। এই মাশান গাছে
থাকেন এবং মিষ্টিস্বরে
ডেকে লোককে ভুলিয়ে
বিপদে ফেলেন।
৯। নাঙ্গা মাশান – এই
মাশান সবসময় উলঙ্গ
থাকেন। একে দেখতে পেলেই
মানুষের মৃত্যু হয়।
১০। বিষুয়া মাশান – এই
মাশান সর্বত্র ঘুরে
বেড়ান। কোনও মানুষের
ওপর ভর করলে তার
সর্বাঙ্গে ব্যথা হয়।
১১। ওবুয়া মাশান – এই
মাশানের বসবাসের
নির্দিষ্ট কোনও জায়গা
নেই। ভর করলে মানুষ
কেবল বমি করতে থাকে।
১২। শুকনা মাশান –
বসবাসের নির্দিষ্ট
জায়গা নেই। এই মাশান
নিজেও দেখতে শীর্ণকায়
আর কারোর ওপর ভর করলে
সেই মানুষটিও ক্রমে
শীর্ণকায় হতে থাকে।
১৩। ভুলা মাশান – জনহীন
মাঠে বাস করেন। রাতে
মানুষকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে
যান।
১৪। ড্যামসা মাশান – ঘন
বনে থাকেন। আর্দ্র
পরিবেশে সক্রিয়।
জঙ্গলের কাছে
বসবাসকারী মানুষের ওপর
ভর করেন।
১৫। আঙ্গিয়া মাশান –
আঙ্গিয়া মানে রঙ্গিয়া।
এই মাশান নানারকম রূপ
ধরে রাতে মানুষকে বিপদে
ফেলেন।
১৬। ছলনার মাশান –
সর্বত্র বাস করেন। নানা
ছলে মানুষকে বিপদে
ফেলেন।
১৭। ন্যাড়া মাশান – এই
মাশানও সব জায়গাতেই
থাকেন। মাথা ন্যাড়া।
মানুষের চরম শত্রু।
১৮। কলির মাশান –
গ্রামের সব জায়গাতেই
থাকতে পারেন, আর
মানুষের ওপর এঁর
প্রতিপত্তি ও ক্ষতি
করার ক্ষমতা সবচেয়ে
বেশি।
এর বাইরেও মাশানের
শোলাশিল্পীদের মধ্যে
কাজ করতে গিয়ে তাঁদের
কাছ থেকে আরও কিছু কিছু
মাশানের কথা জেনেছি,
যেগুলির ধারণা সভ্যতার
মিশ্রণের ফলেই তৈরি
হয়েছে। বা অনেক
ক্ষেত্রেই দেখা যায় একই
মাশানকে স্থানভেদে
আলাদা আলাদা নামে ডাকা
হয়।
যেমন, কামুক্ষা মাশান।
এঁর পাঁচটা মাথা। বাহন
চক্র ও গদা। ভর করলে
মানুষ পাগল হয়ে যায়।
এঁর পুজো নদীর ধারে হয়।
জীন মাশান। এঁর বাহন
ঘোড়া। পিচলা মাশানের
সঙ্গে এঁর সাদৃশ্য
পাওয়া যাচ্ছে। শুর
মাশান । এঁর বাহন শুয়োর,
চারটে হাত, হাতে
তলোয়ার। রাত্রিবেলা
মাঠের মাঝখানে এঁর পুজো
দেওয়া হয়। ভর করলে
মানুষ আস্তে আস্তে
দুর্বল হয়ে যায়। ওবুয়া
মাশান ও শুকনা মাশানের
সঙ্গে মিল পাওয়া
যাচ্ছে। জলুকা মাশান ।
এঁর বাহন মোষ। ভর করলে
জ্বর ও গায়ে ব্যথা হবে।
আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন
দেখে চিৎকার করে উঠবে।
শ্মশান মাশান। এঁর
চারটে হাত। বাহন ঘোড়া।
ভর করলে চোখ লাল হয়ে
যাবে, জ্বর আসবে। কাল
মাশানেরই অপর নাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
এক জলপাইগুড়ি জেলার
রাজগঞ্জের এক শোলা
শিল্পীর মতে মুসলিম
ধর্মের পির ফকিরদের
প্রভাবেও মাশানের
প্রকারে কিছুটা প্রভাব
ফেলেছে। যেমন জিন, পরি
এসবের সঙ্গে পৈরি ও
ভুলা মাশানের
কাজকর্মের ধরন মিলে
যায়। পরবর্তীকালে
স্থানীয় কিছু লোকদেবতা
বা উপমাশান তৈরি হয়েছে।
যাকে আসাম অঞ্চলে
সঙ্গীদেবতা বলে। এরকমই
একটি সঙ্গীমাশান বা
উপমাশান হল জিনপৈরি।
এছাড়া কোচবিহারের
আলোকঝাড়ি গ্রামের
মাশানের নিত্যপুজোর
ব্যবস্থা আছে। তবে শনি
ও মঙ্গলবারে বড় করে
পুজো হয়। বৈশাখ মাসের
শেষ শনি বা মঙ্গলবারে
বাৎসরিক পুজো হয়। দূর
দূরান্ত থেকে ভক্ত
সমাবেশ হয়। এই মাশানের
তিনফুট উঁচু মাটির
মূর্তি। পদ্মাসনে
আসীন। এঁর বাহন হাতি।
ডান হাতে দণ্ড এবং বাঁ
হাতে একটি শাল মাছ।
এতো গেল মাশানের
বর্ণনা। কিন্তু
মাশানের ভাবনা কোথা
থেকে এসেছে তা নিয়ে
বিশ্লেষণ করতে গেলে
আমাদের একবার ইতিহাসের
পাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া
দরকার। সাধারণভাবে বলা
যায় উত্তরবঙ্গের সবকটি
জেলা, অধুণা বাংলাদেশের
রংপুর, দিনাজপুর
প্রভৃতি জেলায় মাশানের
পুজোর বা এই
লোকবিশ্বাসের প্রচলন
আছে। কিন্তু কীভাবে এই
বিশ্বাস গড়ে উঠল?
অধ্যাপক ডঃ আনন্দগোপাল
ঘোষ তাঁর “বৃহত্তর
উত্তরবঙ্গে
বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ও
বিলয়ের বৃত্তান্ত”
প্রবন্ধে বলেছেন,
উত্তরবঙ্গের তথা
বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের
বিশেষ ভৌগলিক
অবস্থানের জন্যই
বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির
সঙ্গে এখানকার
অধিবাসীদের ঘনিষ্ঠ
যোগসূত্র স্থাপিত
হয়েছিল। আমাদের মনে
রাখা দরকার যে হিমালয়
সানুদেশের তরাই
অঞ্চলের কপিলাবস্তুতে
গৌতম বুদ্ধের জন্ম
হয়েছিল। বুদ্ধের জন্ম ও
কর্মস্থল ভৌগলিকভাবে
বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের
বৃত্তেরই প্রান্তীয়
অঞ্চল।(পৃঃ২৭)
উত্তরবঙ্গ এক মিশ্র
সংস্কৃতির দেশ। এই
প্রসঙ্গে গবেষক ডঃ
বিমলেন্দু মজুমদার
তাঁর একটি প্রবন্ধে
বলেছেন যে
প্রাক-ঐতিহাসিক সময়
থেকেই এখানকার
চিরাচরিত
লোকসংস্কৃতির মধ্যে
তিব্বত, ভুটান, নেপাল,
সিকিম, বাংলা, বিহার,
কামরূপ প্রভৃতি
স্থানের কিছু কিছু
সাংস্কৃতিক উপাদান
মিশে গেছে। রাজনৈতিক ও
ধর্মীয় পরিবর্তনের
সঙ্গে সঙ্গে
উত্তরবঙ্গের মানুষেরা
এই লোকজ উপাদানগুলি
আত্মস্থ করে নিয়েছেন।
আবার এই অঞ্চল ছিল
রাজনৈতিক ও
বাণিজ্যিকভাবে চিন,
তিব্বত, নেপাল, সিকিম ও
ভুটানের সঙ্গে বাংলার
যোগাযোগের প্রধান
রাস্তা। প্রাচীন
রেশম-পথ বা সিল্ক-রুট এই
অঞ্চলের মধ্যে দিয়েই
চলে গেছে। এই পথ দিয়ে
অনেক বৌদ্ধ শ্রমণ ও
ব্যবসায়ীরা যাতায়াত
করতেন। আবার এই অঞ্চল
তার ধর্মীয় রীতিনীতির
ক্ষেত্রে
যোগিনী-তন্ত্রের জন্য
বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য।
এই সবকটি উপাদান
পরিশেষে এখানকার
চিরাচরিত সামাজিক
প্রথা, লোকবিশ্বাস এবং
লোকশিল্পকে প্রভাবিত
করেছে। যা এখনও স্থানীয়
শিল্পীদের(দেও-মালি)
মধ্যে দেখা যায়। এঁরা
শোলার কাজ করেন। মূলত
গ্রামীণ এলাকাতেই
এঁদের বাস। শোলা দিয়ে
বিভিন্ন মূর্তি, পট
ইত্যাদি তৈরি করেন, যা
প্রধানত ধর্মীয়
প্রয়োজনেই ব্যবহার করা
হয়। এই মূর্তিগুলির
মধ্যে মাশান, পইরি, যখা,
হুদুমদেও, তিস্তাবুড়ি
প্রভৃতির উত্তরবঙ্গের
রাজবংশী, পালিয়া, খ্যান,
যুগি, পাল, দেবনাথ, রাভা
প্রভৃতি সম্প্রদায়ের
জনজীবনে বিশেষ ভূমিকা
রয়েছে। স্থানীয় এই
সম্প্রদায়ের
জীবনযাত্রা
প্রকৃতিগতভাবে খুবই
সরল এবং সৎ। তাঁরা এখনও
তাঁদের প্রথাগত ধর্ম
এবং লোকজ সংস্কৃতি লালন
করে চলেছেন বছরের পর
বছর ধরে।
ডঃ বিমলেন্দু
মজুমদারের মতে মাশান
উত্তরবঙ্গের
জাতি-জনজাতিদের
ভূত-প্রেত, আত্মা
ইত্যাদির অর্চনার(spirit cult)
প্রথা এবং তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্মের সংমিশ্রণ
থেকেই মাশানের ভাবনার
উৎপত্তি। মন্ত্র এবং
যন্ত্র -এ দুই হল
বজ্রযানের সাধনার
উপকরণ। যন্ত্র হল
মোহিনী প্রতীক, যা সঠিক
ভাবে আঁকতে হয়। মোহিনী
প্রতীক হল religious symbolism।
প্রাথমিকভাবে মাশান
দেখতে পাওয়া যায় যন্ত্র
বা ডায়াগ্রামের রূপে
সিল্কের কাপড়ে আঁকা
অবস্থায়, যার সঙ্গে
বিভিন্ন মন্ত্র জুড়ে
দেওয়া হত। লোকবিশ্বাস
ছিল এবং বর্তমানেও আছে,
এই মন্ত্রগুলি মানুষের
বিভিন্ন শারিরীক ও
মানসিক রোগব্যাধির হাত
থেকে রক্ষা করবে।
স্থানীয় লোকবিশ্বাস
বিভিন্ন মাশান কুপিত
হওয়ার ফলেই মানুষ
রোগযন্ত্রণার কবলে
পড়ে। এরকম শোলার তৈরি
মূর্তির প্রচলন একসময়
সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া
জুড়েই ছিল।
এবার একটু বৌদ্ধধর্মের
প্রসঙ্গে আসা যাক।
গবেষক রণদীপম বসু তাঁর
“বৌদ্ধ-তন্ত্রের
ক্রমবিকাশ”(*১)প্রবন্ধে
বলেছেন, নরেন্দ্রনাথ
ভট্টাচার্যের মতে,
মহাযান সাহিত্যে ধারণী
বা রক্ষামূলক
মন্ত্রশাস্ত্রের একটি
বিশেষ ভূমিকা আছে।এই
রকম একটি ধারণীর
সঙ্কলনের নাম
পঞ্চরক্ষা যার প্রথমটি
পাপ, রোগ এবং অপরাপর
অঘটনের প্রতিরোধ কল্পে
মহাপ্রতিসরার উদ্দেশে,
দ্বিতীয়টি ভূতপ্রেত
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
মহাসহস্রপ্রমর্দিনীর
উদ্দেশে, তৃতীয়টি
সর্পবিষ থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য
মহামায়ূরীর উদ্দেশে,
চতুর্থটি প্রতিকূল
গ্রহশান্তি, বন্য পশু ও
বিষাক্ত কীটপতঙ্গ থেকে
রেহাই পাওয়ার জন্য
মহাসীতবতীর উদ্দেশে
এবং পঞ্চমটি
রোগশান্তির জন্য
মহামন্ত্রানুসারিণীর
উদ্দেশে রচিত। তিব্বতী
তাঞ্জুর ও কাঞ্জুর
গ্রন্থমালায়, চৈনিক
ত্রিপিটকে এবং
মহাযানের উপর রচিত নানা
বইতে এই রকম অসংখ্য
ধারণীর পরিচয় পাওয়া
যায়। এই মন্ত্রশাস্ত্র
মন্ত্র নয় বা
মন্ত্রযানের পথিকৃৎ যা
অবলম্বনে বজ্রযান
প্রমুখ তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্ম গড়ে
ওঠে।(ধর্ম ও সংস্কৃতি,
প্রাচিন ভারতীয়
প্রেক্ষাপট,পৃঃ
১০২-১০৩)
প্রাক বৌদ্ধ যুগে
তিব্বতে এক প্রাকৃতিক
ধর্ম খুব প্রসার
পেয়েছিল, তাকে বলা হয়
'বোন-পা’ ধর্ম। এই ‘বোন’
পন্থীরা কিছুটা
ব্রাহ্মণ্য
শৈবতন্ত্রের মতো
পরমেশ্বর ও শক্তির
উপাসনায় বিশ্বাস করতো
এবং অলৌকিক শক্তি অর্জন
করার জন্য সাধনা ও
ক্রিয়া করাকে বিশেষ
প্রধান্য দিত। তাদের
মতে, জীবের
প্রাণস্পন্দন হলো
মহাশূন্যের খণ্ড
প্রকাশ এবং 'বোনকায়'
জীবের অন্তরেই বিরাজ
করেন। এই ধর্মই
বৌদ্ধ-ধর্মকে প্রভাবিত
করেছিল। এই ধর্মের
সাধনা ও ক্রিয়াপদ্ধতি
বৌদ্ধ-ধর্মের মধ্যেও
ঢুকে গিয়েছিল। আবার
আমরা দেখি যে,
তান্ত্রিক
বৌদ্ধ-ধর্মের বিভিন্ন
বইতে সাধনা ও সিদ্ধি,
মুদ্রা ও ধ্যান, পুজো ও
দেবদেবীর
মূর্তিকল্পনা, বিভিন্ন
ধরনের যোগের কথা আলোচনা
করা হয়েছে। মূল
বৌদ্ধ-ধর্মে কিন্তু
এইসব আচার-অনুষ্ঠানের
কথা পাওয়া যায় না, বরং
হিন্দুদের বিভিন্ন
রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে এর
মিল আছে। আর এগুলোই পরে
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন
আচারের সঙ্গে মিলেমিশে
এক সহজিয়া বৌদ্ধ-ধর্ম
তৈরি হয়। আসলে,
ব্রাহ্মণ্যবাদ আর
তুর্কীদের আক্রমণের
কারণে এমন একটা সময়
এসেছিল, যখন কৌমসমাজের
লৌকিক ধর্মের কাছে
আশ্রয় নেওয়া ছাড়া
বৌদ্ধ-ধর্মের আর কোনও
উপায় ছিল না। ফলে
বৌদ্ধ-ধর্মকে ভীষণভাবে
প্রভাবিত করেছিল
কৌমসমাজের ধর্ম। এই
সহজিয়াপন্থীদের মধ্যে
দেবদেবীর মূর্তি পুজো
আর অনেকটা বাউল ফকিরদের
মতো বিভিন্ন সাধন
পদ্ধতি দেখা যায়, যা মূল
বৌদ্ধ-ধর্মে কোনোদিনই
ছিল না।
এভাবে অষ্টম-নবম শতকে
তান্ত্রিক বৌদ্ধ
মতাবলম্বীদের উদ্ভব
হয়। এই মতকে মন্ত্রযান
বা তন্ত্রযান বলা হয়।
আধ্যাত্মিক দৃষ্টির
তারতম্য অনুসারে এর
তিনটি শাখা হচ্ছে -
বজ্রযান, কালচক্রযান ও
সহজযান। তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্ম থেকে দশম
শতাব্দীতে আবির্ভূত
বজ্রযান সম্প্রদায়টি
দার্শনিক দিক দিয়ে
যোগাচার ও মাধ্যমিক
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের
মিশ্রিত রূপ।(*২)
নেপালের বর্তমান
বৌদ্ধধর্ম প্রধানত
বজ্রযান। এই ধর্মে একটি
বিরাট পুজোপদ্ধতিকে
স্থান দেয়া হয়েছে।
দেবদেবীর সংখ্যাও
অনেক। এই তান্ত্রিক বা
বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের
বিশেষ প্রভাব
উত্তরবঙ্গের
জাতি-জনজাতির ওপর পড়ে।
মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী
যোগীনি প্রমূখ তুচ্ছ
দেবীও বজ্রযানীদের
আরাধ্য ছিল।
বজ্রযানীরা বিশ্বাস
করতেন দেবদেবীদের
করুণা ভিক্ষা করে লাভ
নেই। এদের বাধ্য করতে
হবে। যার মাধ্যমে এঁদের
বশ করা হত, তাদের বলা হত
‘তন্ত্র’। যে কারণে
বজ্রযান কে বলা হয়
তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্ম।মধ্যযুগের
বাংলার লোকায়ত
বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে
দেবীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায় তাঁর
(৪)“লোকায়ত দর্শন” বইতে
লিখেছেন, “বাংলায়
বৌদ্ধধর্ম এমন রূপ
পরিগ্রহ করেছিল যে,
লৌকিক হিন্দু ধর্ম থেকে
তা খুব একটা ভিন্নতর
ছিল না। এই পরিবর্তনকেই
বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান ও
তন্ত্রযান ও সহজযান ও
কালচক্রযানের
রূপান্তর বলে আখ্যাত
করা হয়েছে।“ এরই
প্রভাবে আদি মাশানের
রূপ যন্ত্র বা ছবির
সঙ্গে তন্ত্রের
মিশ্রণে উপস্থাপিত
হয়েছে। বৌদ্ধদের
কালচক্রযানে অনেক
ভয়ঙ্কর দেখতে দেবদেবীর
উপস্থিতি লক্ষ্য করা
যায়। ইতিমধ্যে
বৌদ্ধধর্ম বাংলার
সনাতন ধর্মের সঙ্গে
বিভিন্নভাবে মিশে গেছে,
আবার বাংলার সনাতন
ধর্মও প্রভাবিত হতে
শুরু করেছে বৌদ্ধ
তন্ত্রের দ্বারা।
অর্থাৎ একটা সময়ে এসে
কৌম-সমাজের লৌকিক ধারা
ও বৌদ্ধ নিরাকার সাধনা
মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
যার প্রভাব যেমন
বৌদ্ধ-ধর্মে পড়েছে,
তেমনি সাধারণ জনজাতির
ধর্মীয় লোকাচারেও
পড়েছে। তারই অন্যতম
ফলশ্রুতি হিসেবে
মাশানের ধারণা তৈরি
হয়েছে। মাশানের আকৃতি ও
চেহারায় এই তান্ত্রিক
বৌদ্ধধর্মের
দেবদেবীদের চেহারার
করালভাব দেখতে পাওয়া
যায়। মাশানকেও একইভাবে
মন্ত্র ও বলিদানের
মাধ্যমে তৃপ্ত করার
রীতি আছে। মহাকাল
বজ্রযানীদের এক
উল্লেখযোগ্য দেবতা।
মহাকালের মূর্তির
সঙ্গে কাল মাশানের
নিবিড় সাদৃশ্য লক্ষ্য
করা যায়। মহাকাল হিন্দু
ধর্মের শিবেরই এক
বিবর্তিত রূপ। আগেই
বলেছি, মাশানকেও শিব বা
শিবের প্রতিনিধি
হিসেবে কল্পনা করা
হয়েছে। শিব শ্মশানে
থাকেন, কাল মাশানও
শ্মশানে থাকেন। তন্ত্র
এমনভাবে উত্তরবঙ্গের
জাতি-জনজাতির
লোকবিশ্বাসে প্রভাব
ফেলেছিল যে তাঁরাও
প্রকৃতির বিভিন্ন
প্রতিকূল অবস্থার
সঙ্গে মোকাবিলার জন্য
মাশানের মতো এক
লোকদেবতার কল্পনা করে
ওঝা গুণিন প্রমুখের
মাধ্যমে তাঁকে বশ করার
কথা চিন্তা করেছিলেন,
যা ছিল বজ্রযানীদেরও এক
সংস্কার(ritual)।
আমরা অধ্যাপক
নীহাররঞ্জন রায়ের
বাঙালীর ইতিহাস বইটি
থেকে এ প্রসঙ্গে একটু
দেখে নিতে পারি, তিনি এই
বইয়ের আদিপর্বে
‘ধর্মকর্ম :
ধ্যান-ধারণা’ অধ্যায়ে
মহাযানের বিবর্তন
প্রসঙ্গে বলেছেন–
অষ্টম ও নবম শতকে
মহাযান বৌদ্ধধর্মে
নূতনতর তান্ত্রিক
ধ্যান-কল্পনার স্পর্শ
লাগিয়াছিল এবং তাহার
ফলে দশম শতক হইতেই
বৌদ্ধ ধর্মে গুহ্য
সাধনতত্ত্ব,
নীতিপদ্ধতি ও
পূজাচারের প্রসার দেখা
দিয়াছিল। এই গুহ্য
সাধনার ধ্যান-কল্পনা
কোথা হইতে কী করিয়া
মহাযান-দেহে প্রবেশ
করিয়া বৌদ্ধ ধর্মের
রূপান্তর ঘটাইল এবং
বিভিন্ন ধারার সৃষ্টি
করিল বলা কঠিন।
মহাযানের মধ্যে তাহার
বীজ সুপ্ত ছিল কিনা
তাহাও নিঃসংশয়ে বলা যায়
না। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে
আচার্য অসঙ্গ সম্বন্ধে
বলা হইয়াছে,
পর্বত-কান্তারবাসী
সুবৃহৎ কৌম-সমাজকে
বৌদ্ধধর্মের সীমার
মধ্যে আকর্ষণ করিবার
জন্য ভূত, প্রেত, যক্ষ,
রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী,
পিশাচ ও
মাতৃকাতন্ত্রের নানা
দেবী প্রভৃতিকে অসঙ্গ
মহাযান-দেবায়তনে স্থান
দান করিয়াছিলেন। নানা
গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র,
ধারণী (গূঢ়ার্থক অক্ষর)
প্রভৃতিও প্রবেশ
করিয়াছিল মহাযান
ধ্যান-কল্পনায়,
পূজাচারে, আনুষ্ঠানিক
ক্রিয়াকর্মে এবং তাহাও
অসঙ্গেরই অনুমোদনে। এই
ঐহিত্য কতটুকু
বিশ্বাসযোগ্য, বলা
কঠিন। তবে, বলা বাহুল্য,
এই সব গুহ্য, রহস্যময়,
গূঢ়ার্থক মন্ত্র,
যন্ত্র, ধারণী বীজ,
মণ্ডল প্রভৃতি সমস্তই
আদিম কৌম সমাজের
যাদুশক্তিতে বিশ্বাস
হইতেই উদ্ভূত। সহজ
সমাজতান্ত্রিক
যুক্তিতেই বৌদ্ধ ও
ব্রাহ্মণ্যধর্ম
উভয়েরই ভাব-কল্পনায় ও
ধর্মগত আচারানুষ্ঠানে
ইহাদের প্রবেশ লাভ কিছু
অস্বাভাবিক নয়। উভয়কেই
নিজ নিজ প্রভাবের সীমা
বিস্তৃত করিবার
চেষ্টায় আদিম
কৌম-সমাজের সম্মুখীন
হইতে হইয়াছিল; তাহা
ছাড়া উভয় ধর্ম
সম্প্রদায়েরই নিম্নতর
স্তরগুলিতে যে সুবৃহৎ
মানবগোষ্ঠী ক্রমশ
আসিয়া ভিড় করিতেছিল
তাঁহারা তো
ক্রমহ্রস্বায়মান
আদিবাসী সমাজেরই
জনসাধারণ। তাঁহারা তো
নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস,
ধ্যান ধারণা, দেবদেবী
লইয়াই বৌদ্ধ বা
ব্রাহ্মণ্য ধর্মে
আসিয়া আশ্রয়
লইতেছিলেন।(৫২৫-২৬)
রণদীপম বসুর মতে,
শশিভূষণ দাশগুপ্তের
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী
বৌদ্ধ-তন্ত্রের প্রচুর
প্রসার ঘটেছিলো
মহাচীনে – অর্থাৎ
বিহার-বঙ্গ-আসামের কিছু
অঞ্চল এবং
নেপাল-তিব্বত-ভুটান
প্রভৃতি অঞ্চলে। ফলে এই
অঞ্চলের প্রসিদ্ধা
কিছু কিছু দেবী
বৌদ্ধ-তন্ত্রে স্থান
পেয়েছিলেন, তাঁরাই
সম্ভবত বৌদ্ধতন্ত্রের
মারফতে
হিন্দু-তন্ত্রাদিতেও
দেবী বলে গৃহীতা এবং
স্বীকৃতা হয়েছেন। তারা
বা উগ্রতারা বা একজটা
দেবী মূলত তিব্বতের
দেবী বলে ডক্টর
প্রবোধচন্দ্র বাগচীর
বিশ্বাস [Evolution of the Tantras]।
পর্ণশবরী দেবীও এভাবে
বৌদ্ধ-তন্ত্র থেকেই
গৃহীত বলে ডক্টর
বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের
মত [সাধনমালার ভূমিকা
এবং Buddhist Iconography]।
হিন্দু-তন্ত্রে বর্ণিত
ষট্চক্রের
অধিষ্ঠাত্রী ডাকিনী,
হাকিনী, লাকিনী, রাকিণী,
শাকিনী দেবীগণের সবাই
না হলেও কেউ কেউ
মহাচীনাঞ্চল থেকে
গৃহীত বলে শশিভূষণ
দাশগুপ্তের
অভিমত।“(*৩)
এর থেকে আমরা এই
সিদ্ধান্তে আসতে পারি
যে একটা সময়ে
হিমালয়-সংলগ্ন বৃহৎ
কৌম-সমাজ বৌদ্ধ-ধর্ম
গ্রহণ করার ফলে উভয়ের
লৌকিক সংস্কারের
আদান-প্রদানের মাধ্যমে
এক অপর ধারার
লোক-সংস্কৃতির জন্ম
দেয়। রাজবংশী সমাজের
ক্ষেত্রে তান্ত্রিক
বৌদ্ধ-ধর্মের প্রভাবের
ফলশ্রুতি হল মাশান।
পরিশেষে বলি, মাশানের
সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে
আছে মানুষের সামাজিক
মূল্যবোধ। সেই কোন
প্রাচীনকাল থেকে এর
সঙ্গে জাতি-জনজাতির
যাপন-প্রণালী জড়িয়ে
আছে। বিজ্ঞান মানুষের
জীবনযাত্রা দিনে দিনে
আরও উন্নত করে তুলেছে,
কিন্তু তার হাত ধরেই
আবার এই পৃথিবীতে এসেছে
ভোগবাদের আগ্রাসী
আক্রমণ। ফলে, এই
মূল্যবোধ নষ্ট হতে হতে
একদম তলানিতে গিয়ে
ঠেকেছে। স্থানীয়
মানুষেরা এবং
মাশান-শিল্পীরা বহু
সংগ্রাম করে এই
লোকবিশ্বাসের ধারাকে
বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার
দায়িত্ব সমাজকে নিতে
হবে। নইলে এই সুপ্রাচীন
ঐতিহ্য অন্যান্য বহু
লোক-সংস্কৃতির ধারার
মতো কালের গতিতে একসময়
হারিয়ে যাবে। সভ্যতার
অগ্রগতির ফলে মানুষ
আধুনিক হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে নিজের কৃষ্টি
সংস্কার সবকিছুকে
অস্বীকার করে এক
বিশ্বায়িত
জীবনযাত্রার দিকে চলে
যাচ্ছে। শিকড়ের কথা সে
কিন্তু ভুলেই যাচ্ছে।
এগিয়ে যাওয়া অপরাধ নয়,
অপরাধ নিজের মাটিকে
ভুলে যাওয়া। তাই এই
মাশানের ধারাকে
বাঁচিয়ে রাখার জন্য
শুধু স্থানীয় মানুষ নয়,
সকল আধুনিক মানুষকেই
এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ
১। উত্তরবঙ্গের ইতিহাস
ও সমাজ ৩- ডঃ আনন্দগোপাল
ঘোষ, ডঃ পাপিয়া দত্ত
২।দ্য রাজবংশীস অফ
নর্থবেঙ্গলঃ ডঃ
চারুচন্দ্র সান্যাল
৩।উত্তরবঙ্গের
রাজবংশী সমাজের
দেবদেবী ও পূজা-পার্বণঃ
ডঃ গিরিজাশঙ্কর
রায়(গবেষণা পত্র)
৪। লোকায়ত দর্শণঃ
দেবীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায়
৫। নীহাররঞ্জন রায়/
বাঙালীর ইতিহাস
আদিপর্ব
৬। প্রাচীন গমীরা নাচ ও
মাশানপুজোঃ ডঃ দীপক
কুমার রায়।
৭।
https://www.anandabazar.com/district/north/%E0%A6%89%E0%A6%A
4-%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A1-%E0%A6%9A-
1.65085
*১https://horoppa.wordpress.com/2017/10/29/tantric-buddhis
m-6-evolution-of-tantras/ (তথ্যসূত্র:
রণদীপম বসু)
*২
(https://horoppa.wordpress.com/2011/11/10/4676-philosophers-
the-schools-of-buddhism
*৩
https://horoppa.wordpress.com/2017/10/28/tantric-buddhism-4-
devibad/#more-8275
ফেসবুক মন্তব্য