এমনই বরষা ছিল সেদিন।
এই মহানগরীতে প্রথম
যেদিন পা রেখেছিলাম।
সেও প্রবল বরষার এক
সন্ধ্যা। সপসপে ভিজে
শহর অথচ বেশ সচল। তারপর
লাগাতার বেশ কদিন আর
সূর্যের মুখ দেখি নি।
আরব সাগর থেকে আসা
হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা
এসে লাগছিল কাচের
সার্শিতে। স্লাইডিং
জানলার ফাঁক দিয়ে শিস
দিচ্ছিল হাওয়া। ঠিক যেন
রেডিও-নাটকের আবহাওয়া।
সেই প্রথম দেখা এবং
প্রেমে পড়া। বম্বে তখনও
মুম্বাই হয় নি। কলকাতা
বা বাংলার মত কোনও
কালবৈশাখী ঝড় বৃষ্টি
এখানে হয় না। বৃষ্টির
পথ চেয়ে তাই চাতক হয়ে
থাকে সবাই। এ শহরে এই
সীজনটাকেই একমাত্র
ভালো করে চেনা যায়।
অনুভব করা যায়।
এখানে এসে শিখেছি
বর্ষার প্রস্তুতি কী
করে নিতে হয়। সেভ ফর দ্য
রেনি ডে, কথাটা এরা খুব
মেনে চলে। বম্বে তথা
মুম্বাইর আদি ও প্রকৃত
বাসিন্দা হলো কোলি
সম্প্রদায়। যাদের পেশা
প্রধানত সমুদ্রে মাছ
ধরা। বড় বড় নৌকা বা
ট্রলার নিয়ে গভীর
সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়।
তখন দিনের পর দিন তাদের
জলেই কাটে। বর্ষা শুরুর
প্রথম দিকেই এদের গভীর
সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ হয়ে
যায়। প্রায় তিন মাস
এদের কোনো কাজ কর্ম
থাকে না। তাই এখানে
সুখা মচ্ছি বা সুটকী
মাছ বানানো হয় যাতে
বর্ষা কালেও মাছ থেকে
বঞ্চিত না হতে হয়। শুধু
বাঙালী নয় মুম্বাই এর
মারাঠী সম্প্রদায়ও খুব
মাছ-ভক্ত।
মুম্বাই যতটা
মারাঠীদের ততটাই
গুজরাটী ও সিন্ধিদেরও।
আমার গুজরাটী
নিরামিষাশী সহকর্মীকে
দেখেছি বর্ষার আগে
কাঁচা আমের নানা রকম
আচার বানিয়ে রাখতে।
তিন মাসের জন্য চাল ডাল
তেল নুন সব কিনে ভরে
রাখতে। এখন হয়ত আগের মত
তিন মাস জুড়ে বৃষ্টি হয়
না। কিন্তু রেনি ডের
জন্য সঞ্চয় করে রাখে
সবাই। মুম্বাইবাসী
বাঙালীরাও অনেকে এদের
অনুসরণ করে। ওদের কাছ
থেকে শেখা কিছু এ'ধরনের
টিপস লক-ডাউনে উপকারে
লাগলো।
প্রায় তিন মাস জুড়ে
মুম্বাই যেন মেঘের শহর
হয়ে যায়। ঠিক যেমন
হিমালয়ে মেঘ এসে খেলা
করে। আকাশটা মনে হয়
হাতের নাগালে। মুম্বাই
থেকে সামান্য দূরে
লোনাভালা যেতে পারলে
আরও জমিয়ে উপভোগ করা
যায় মেঘ আর বৃষ্টির
খেলা। মুম্বাই শহরের
মধ্যেই আছে বিশাল
রিজার্ভড্-ফরেষ্ট।
সঞ্জয় গান্ধী
ন্যাশানাল পার্ক।
বিশাল এই পার্কে আর
একটা মুম্বাই শহর
নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়তে
পারে। সেই ফরেষ্টে আছে
কয়েকশ বছর আগের
অনেকগুলো বৌদ্ধ
গুম্ফা। বর্ষাকালে
সবুজ জঙ্গলের মধ্যে এই
গুহার নানা জায়গা থেকে
অঝোরে ঝর্ণার জল বয়ে
যায়। আর তার নীচেই হয়
আমাদের মত কিছু হৈ চৈ
পার্টির মনসুন পিকনিক।
পশ্চিমঘাট পর্বত দিয়ে
ঘেরা এই শহরে এমন
অগুনতি মরশুমি ঝর্ণা
বর্ষার অন্যতম
আকর্ষণ।
এত বৃষ্টিতে শহরে জল
জমবে না তাও কি হতে পারে?
সব শহরের মত এখানেও আছে
পরিকল্পনাহীন ঘন বসতি।
বছরে দু-একদিন রেল লাইন
ডুবে ট্রেনও বন্ধ হয়ে
যায়। সমুদ্রকে দখল করে
তৈরী হয়েছে আধুনিক
নগরায়ন। ফলে অতি
বৃষ্টিতে তা যে জলমগ্ন
হবে এ আর অবাক হবার মত কি
এমন কথা!। তবে বেশীর ভাগ
বাড়তি জল আরব সাগর তার
বুকে টেনে নিয়ে কখনো
কখনো বানভাসি থেকে
বাঁচিয়েও দেয়। তবুও
২০০৫ সালে সমুদ্রকে
হেরে যেতে দেখেছি
বৃষ্টির কাছে।
সে ভয়ানক স্মৃতি আজও
অনেকের মনে আছে। তখন
আমার স্বামী তিন সপ্তাহ
হিমালয়ে ট্রেকিং-এ
গেছে। কোনও রকমে অফিস
থেকে জল ভেঙে বাড়ী
পৌঁছাই। একাই কাটাচ্ছি
কদিন। অদ্ভূত অন্ধকার
করেছিল চারিদিকে।
ইলেকট্রিসিটিও থাকারও
প্রশ্ন নেই, সেদিন যখন
জল থৈ থৈ সারা শহর
অন্ধকারে ডুবে গেছিল
তখন আমার দরজায় টকটক
আওয়াজ। সাহস করে খুলে
দেখি দরজায় আমার ঠিকে
কাজের বৌটি দাঁড়িয়ে।
ওদের ঘর জলে ভেসে গেছে।
ওরা বাচ্চা-কাচ্চা সহ
দশজন আমার ঘরেই রাত
কাটাল। কীভাবে যে
মোমবাতির আলোয় ওদের
খাওয়া থাকার ব্যবস্থা
করেছিলাম এখন ভাবলে
অবাক লাগে।
আবার যেহেতু এ
দ্বীপ-শহরের মাটির নিচে
নেই মিঠা জলের ভান্ডার,
তাই বৃষ্টির জলই জোগান
দেয় সম্বৎসরের পানীয়
জল। তুলসী, বিরার বা
পাওয়াই লেকের জলতল কমে
গেলেই মানুষের কপালে
পড়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
তাই ব্যস্ততম এই শহরের
প্রাত্যহিক নাগরিক
জীবনের শত অসুবিধা
ঘটালেও বৃষ্টির আকাল
ঘটলেও আমরা নিশ্চিন্তে
থাকতে পারি না। শহরের
ধূসর আকাশে সমবেত নীরব
প্রার্থণা গুঞ্জরিত
হতে থাকে, আল্লা মেঘ দে
পানি দে...।
ছবিঃ রুদ্র মণ্ডল
ফেসবুক মন্তব্য