এক নম্বর
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন
ঢুকছে। আপ নৈহাটি
লোকাল। হুড়মুড়িয়ে
বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ল
বাপি। চায়ের ভাঁড়টা
ডাস্টবিনে ফেলে এগিয়ে
গেল মহিলা কামরার দিকে।
তার এক কাঁধে একটা
স্ট্যান্ড, তাতে হরেক
রকমের কানের দুল।
দমদম জংশনে ট্রেন থামার
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে
ফাঁকা হয়ে গেল
প্ল্যাটফর্মে
মহিলাদের দাঁড়ানোর
জায়গা। লাফিয়ে ট্রেনে
উঠে পড়ে বাপি। "দেখি
দিদি, একটু ভেতরে যেতে
দিন তো।"
"নিজেই ঢুকতে পারছি
না, আপনাকে ঢোকার জায়গা
দিই কী করে বলুন তো?
দেখছেন তো ট্রেনে কী
ভিড়!"
কাঁধ থেকে দুলের
স্ট্যান্ডটা খানিকটা
উপরে তুলে ভেতরে ঢুকে
যায় বাপি।
"যা নেবেন, ২০ টাকা।
নানা রকম ডিজাইনের দুল
আছে।"
এই লাইনে পাঁচ বছর হয়ে
গেল বাপির। এতদিনে সে
বুঝে গিয়েছে, যার
কেনাকাটার ইচ্ছে আছে সে
প্রথমবারেই হকারকে
ডেকে জিনিস দেখতে
চাইবে। আর যে কিনবেই না,
শত হাঁকডাকেও সে ফিরে
তাকাবে না। ট্রেনে
হকারি করবে, এমনটা
বাপি কখনো ভাবেনি।
বছর পাঁচেক আগের একটা
রাত তার ও তার মায়ের
জীবনটা হঠাৎই পাল্টে
দেয়। ট্রেন থেকে
তাড়াহুড়ো করে নামার সময়
বাপির বাবা মারা যায়।
মাসখানেক পরে বাপি ও
তার মায়ের হাঁড়ি আলাদা
করে দেয় দাদা, বৌদি।
দুজনের পেট ভরাতে
ট্রেনে ট্রেনে হকারি
করা শুরু করল সে।
বাবাও ছিল ট্রেনের
হকার।
তবে দাদা, বৌদির সঙ্গে
সম্পর্ক ভালো না হলেও
ভাইপোর সঙ্গে কিন্তু
খুব ভাব বাপির। আর
বিল্টুও কাকা বলতে
অজ্ঞান। বারান্দায়
একটা কাক এসে বসুক বা
মাছের কাঁটা খাওয়া নিয়ে
দুই বেড়াল ঝগড়া করুক,
সব কথা কাকাকে তার বলা
চাই। কাকা ফেরার পর রোজ
রাত ৯টার খোশগল্পটা না
হলে যেন একরত্তির ভাত
হজম হয় না।
বাপির কাছে বিল্টুর
নতুন আবদার, একটা
সাইকেল কিনে দিতে হবে
তাকে। রোজ বিকেলে পাড়ায়
একটা বাচ্চা সাইকেল
চালায়। তাই তার-ও শখ
হয়েছে, সকাল-বিকেল
দু'বেলা সাইকেল চালাবে
সে। সে থাকবে সামনে আর
পিছনে কখনো কাকা, কখনো
মা, বাবা কখনো ঠাকুমা।
গত কয়েক দিন ধরে রোজ-ই
একবার করে কাকাকে
সাইকেলের কথা মনে করিয়ে
দিচ্ছে সে।
দমদমে একটা ভালো
সাইকেলের দোকান আছে।
বাপি সেখানে গিয়ে একটা
সাইকেল পছন্দ করে
এসেছে। টকটকে লাল রঙের
তিন চাকার সাইকেল। দাম
হাজার টাকা। টেনেটুনে
মা-ছেলের সংসার চলে, তার
মধ্যেই একটু একটু করে
টাকা জমিয়েছে সে। আজকেই
সাইকেল কিনতে যাওয়ার
কথা বাপির। আজকে আর
নৈহাটি স্টেশনে নামবে
না সে, দেরি হয়ে যাবে।
ব্যারাকপুরে নেমে যাবে,
তারপর ব্যারাকপুর
লোকাল ধরে দমদমে আসবে।
সেখান থেকে সাইকেল কিনে
সোজা নৈহাটির বাড়ি।
খুশিতে উজ্জ্বল
বিল্টুর মুখটা মনে করে
আপন মনে হেসে উঠলো
বাপি। বিল্টুকে তো সে
বলেইনি যে আজকে তার
উপহার আসছে। আগে থেকে
বলে দিলে কি আর ওই অবাক
হয়ে যাওয়া মুখটা খুশিতে
ভরে উঠতে দেখতে পাবে সে!
বিল্টুর এমনিতে কোনো
বায়না নেই। এই চার বছরে
প্রথম কাকার কাছে কিছু
চেয়েছে সে।
বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে
লাগায় ভাবনায় ছেদ পড়ে
বাপির। যা! এর মধ্যে
বৃষ্টিও নেমে গেল!
সাইকেলটা নিয়ে যাবে কী
করে! একটা বড় প্লাস্টিক
জোগাড় করতে হবে।
"এই ভেতরে যা। এইটুকু
ছেলের পাকামি দেখো! গেট
ধরে ঝুলছে! পা পিছলে
গেলে কী হবে জানিস?"
বাপি দেখে কখন একটা
বাচ্চা ছেলে ট্রেনে উঠে
পড়েছে। এতক্ষণ এক বয়স্ক
মহিলা বকছিল তাকে, বকা
খেয়ে এবার ভেতরে চলে
এসেছে সে। ছেলেটার বয়স
৮ কি ৯। পরনে স্কুল
ইউনিফর্ম, ময়লা সাদা
শার্ট আর নীল
হাফপ্যান্ট। পিঠে
আবার একটা স্কুলব্যাগও
রয়েছে। ওইটুকু একটা
ব্যাগে কম করে
সাত-আটখানা তাপ্পি। চেন
নেই, তার জায়গায় বড় একটা
সেফটিপিন আটকানো।
ভেতরে বাদামি মলাট
লাগানো একটা বই, খাতাও
হতে পারে। আবছা আলোয়
দূর থেকে ঠিক বোঝা
যাচ্ছে না। আর ছেলেটার
হাতে ধরা বাদামের খাজার
পাঁচ-ছ'টা প্যাকেট।
"এই এদিকে শোন।"
বাপির কাছে এগিয়ে গেল
ছেলেটা।
"নামবি কোথায়?"
"শ্যামনগর।"
"কোন ক্লাসে পড়িস?"
"ক্লাস টু।"
"একা একা ট্রেনে
যাচ্ছিস যে! আর কেউ
নেই?"
"মা রোজ বিকেলে আমার
সঙ্গেই থাকে। আমরা
দু'জনে খাজা ফেরি করি।
আজকে শরীরটা খারাপ বলে
আসতে পারেনি মা। কিন্ত
বলেছে স্টেশনে দাঁড়িয়ে
থাকবে। আমি নামলে আমায়
বাড়ি নিয়ে যাবে। আমার
আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেল।
বৃষ্টি পড়ছিল তো, তাই
স্কুলে অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়েছিলাম।"
কী বলবে বুঝতে পারল না
বাপি। হঠাৎ তার সামনে
বিল্টুর মুখটা ভেসে
উঠল।
"এই টাকাটা রাখ। মাকে
বলবি, একটা কাকু
দিয়েছে। এটা দিয়ে একটা
স্কুলব্যাগ কিনবি। আর
শোন, এত ময়লা জামা পরে
স্কুলে যাবি না।"
ছেলেটা এতগুলো টাকা
নিতে চাইছিল না, বাপি
জোর করায় নিতে বাধ্য
হল। হাজার টাকায় একটা
ভালো স্কুলব্যাগ হয়ে
যাবে নিশ্চয়ই।
ট্রেন ব্যারাকপুর
স্টেশনে ঢুকছে। বৃষ্টি
থেমে গিয়েছে। বাতাসে
তখন ভেজা মাটির সোঁদা
গন্ধ।
অলংকরণঃ কল্লোল রায়
ফেসবুক মন্তব্য