
পশ্চিম কোণায় মেঘ জমে উঠেছে তারিনী ইঞ্জিন বন্ধ করে নৌকার হালটা ধরে চুপ করে বসে থাকল। তরতর করে নৌকা বয়ে যাচ্ছে। বাঁয়ে চড়ায় চাষের জমি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে নৌকা ভাঁটার টানে। তারিনীর চোখের সামনে কালো পর্দায় ফুটে উঠছে রঙিন বুদ্বুদ।
"ও কমলি? তোর গায়ে এই লাল ঠুয়া পরসে ক্যামনে হ্যাঁ রে?"
"রসের কতা। তুমার এই সাতগুষ্টির রান্না করতি গ্যালি ত্যাল ছিটবো না?"
"আস্ছা আয় আদর বুলায়দি।"
"ছ্যাড়ান দাও, রাতিরবেলা যদি ঘুমাতি না দাও তো দোর খুইলা বাইরে যাবো নে। যত সুহাগ গতরে, হুম্, একডা শাড়িও তো কিইন্যা আনতি দ্যাখলাম না এই তিন মাসের মইধ্যি।"
উনিশ বছরের কমলির রূপের আঠায় সাতাশ বছরের তারিনী এমন বাঁধা পড়েছিল যে উপেনের বিয়ে খেয়ে এসে সোজা মাকে বলেছিল ঐ মেয়েই তার চাই। অবশ্য কমলির মা, বাপ রাজি না হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। দশবিঘা পৈত্রিক জমি, ছেলের নিজস্ব নৌকা, পাকা পায়খানা, বাথরুম, তিন কামরার ইঁটের দেওয়াল টিনের ছাদওলা ঘর মন্দ কী? শুধু ছেলের ভাইটা পাগল এইটুকুই যা চিন্তার। কমলির মা পাটশাকের ঝোল রাঁধতে রাঁধতে ওর বাবাকে বলেছিল-
"তুমার মেয়ের ধরণধারণ যে মোটে ভালো না হেইডা তো ভালোই জানো। বিশের মা পরশু টেরিয়ে টেরিয়ে যা নয় তাই কলো। কাল নাকি শিতলা মন্দিরের পিছনে নিকিলের সঙ্গি তুমার মেয়ে... এমুন লোভ হ্যার ঐ আগুণি খোরাক যোগাতি পারনোর মতো পয়সা এই ছেলের আছে। তুমি এই ছেলের লগেই ওরে ঝুলাও। ছেলেটারে দেখে বুকাসুকাই লাগলো। কমলি হাতে রাখতে পারবো।"
কমলি অবশ্য তেল চুপচুপে, কালো দীর্ঘদেহী তারিণীকে দেখে নাক সিঁটকেছিল খুব। ওর মা ভালো করে বুঝিয়ে সুজিয়ে বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্তে পাশের বাড়ির উঠতি মেয়েটার কেচ্ছায় মন ডুবিয়ে দিল। ঐদিকে তারিনী কিছুতেই বাগে আনতে পারল না কমলিকে। তারিনীর মা রান্নাঘরে গজগজ করে...
"ন্যাও রূপ ধুইয়া জল খাও। সারাদিন পাড়া টুলায়।ঘ রে মন নাই শুধু রঙ্গ।"
তারিণী অবাক হয়ে শোনে। দুদিন পর জমি থেকে ফিরে দেখে খলখল হাসির আওয়াজে বাড়ি সিঁটিয়ে আছে যেন। কাঁধের গামছায় মুখের ঘাম মোছে তারিনী চাপাকল থেকে জল ভরে পায়খানার দিকে যেতে গিয়ে দেখে একটা মোটর সাইকেল কাঁঠাল গাছতলায় দাঁড় করানো। চিরকাল নিজেরটুকুও দাবি করতে পারেনি তারিনী। তাই সংকোচে এড়িয়ে যায়। দাওয়ায় ফিরতেই কমলি ঝমঝমিয়ে ওঠে-
"কি ব্যাপার এতো তাড়াতাড়ি?"
"কেডায় হাসতেছিলো তোর লগে?"
"ক্যান হাসা বারণ নাকি? নগেন ঠাকুরপো আইসিলো। এমুন সোন্দর ছিনিমার ডালোগ দেয় যে না হেসি পারি না।"
"ও!"
"এই দ্যাহো কেমন লিস্টিপ দিসে আমারে। তুমি তো জীবনে কিসু দিলা না।"
নৌকায় শুয়ে পড়ে তারিণী জলে হাত ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে। স্পষ্ট শুনতে পায় ফিসফাস। তার বৌ পাড়ার নগেনের সাথে এঁটুলির মতো সেঁটে থাকে। এখানে ওখানে ঘোরে ওর মোটর সাইকেলে করে। মাথা চুলকায় তারিণী। সারা শরীরে সুলসুল করে তাপ। রাতেরবেলা বলিষ্ট শরীর দিয়ে জোর করে নৌকা বায় কমলির ভরা নদীতে। নৌকা নোঙর করার পর ডুকরে কাঁদে কমলি-
"মন নাই তুমার, জানোয়ার হইছো।"
নিজের পাশবিকতায় নিজেই অস্থির হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে বসে। আকাশে চাঁদ, নদীতে দুধ ভেসে যাচ্ছে। গুণগুণ গান ভেসে আসে-
"চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি, চাঁদের গায়ে..."
কে গায় এই রাতে। একটু হেঁটে বাঁক ঘুরতেই দেখে বসে আছে তরতাজা ভাই। এপাড়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পড়াশোনা জানা তার ভাই। কলেজে ভর্তি করেও দিয়েছিল তারিনী। তারপর কী যে হল বছর খানেকের মধ্যে ভাইটা হেজে গেল। তারিনী ওর মার কাছে শুনেছে ওর বাবাও নাকি এমন ছিল।
"তোর বাপের আউলা বাউলা কতা শুনতি শুনতি জীবন পার করে দিসি। এখন এই শ্যাষ বয়েসে ছেলেরেও তাই দেকি। ভরা ছাবন মাইস তোর বাপ দিব্ব্যি পেঁয়াজ ভাজা, ডাল দিয়া ভাত খাইলো। তারপর ধড়ফড়ি উঠি বলে 'ম্যাঘ আইজ নদীতে নামবো নক্কী আমি দ্যাখবো' ছুটে নদীর পাড়ে গ্যালো আর সকালে বিসটি থামলি চড়ায় ফুলে ওঠা মরা পালাম। হায় রে!"
ভাইয়ের পাশে বসে তারিনী। গান থামিয়ে কার্তিক বলে-
"দাদা তোর ঘর নেই?"
চোখটা করকর করে তারিনীর। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে আছে। ঝাপসা আলোয় কার্তিক বলে-
"তোর ঘরে একটা জিনিস আছে দাদা। তার গায়ে পায়েসের গন্ধ। আমার ভালো লাগে না।"
"কী যে কস কিচুই বুঝি না। ঘরে চ। রাত করে আর এহানে থাকতে লাগবো না।"
"তুইও এখানে থাক। নইলে ছোবল খাবি। ফিসফিস, চেরা জিভ, ঠাণ্ডা মন, গরম শরীর আর গ্যালোন গ্যালোন পেট্রোল।"
ভাইকে টেনে তোলে তারিনী, গঙ্গায় একটা এলোমেলো হাওয়া পাকিয়ে ওঠে। বাড়ি এনে ঘরে ঢোকায়, ভাইকে বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বোলায়-
"আচ্ছা দাদা তুই পড়িস না কেনো বল তো? বাবা এ নিয়ে তিনবার ভর্তি করালো। ইস্ তোর লজ্জা করে না, চার বছরের ছোটো ভাইয়ের সাথে এক ক্লাসে পড়িস?"
"হ লজ্জা করে, খুব লজ্জা করে তুই চুপ যা।"
"দাদা, যে জীবের গায়ে পায়েসের গন্ধ সে আসলে ঐ গন্ধে ফাঁদ পাতে বুঝলি? ঐ আকাশ, চাঁদ, নদী, তোর ক্ষেতের ফসল সত্যি আর ফাঁদ মিথ্যে, মনে রাখবি কিন্তু।"
বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দেয় তারিনী। রাতে যদি বেরিয়ে যায় আর ঘুমানো হবে না। ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বারান্দার চৌকিতে পাটি পেতে ঘুমায় তারিনী।
তারিনীর ঘুম পায় নদীর জোলো হাওয়ায়। এদিকে ভাসতে ভাসতে কালীপুর ঘাটের কাছে এসে নৌকা লেগেছে। উঠে বসে। নোঙর করে। বাঁশের পাটাতন বেয়ে ইঁটভাঁটার পাশে চঞ্চলের দোকানে এককাপ চা খায়। চঞ্চল টেরিয়ে দেখে বলে-
"কি বাড়ির খবর সব ঠিকাসে?"
"হ, ঠিক আছে।"
"পরশু তোমাগো উদিকের পবন আইসিলো। কলো তুমার সুন্দরী বৌ নাকি তুমারে ঘরে শুতি দ্যায় না?"
তারিনী মুখ তুলে ব্যঙ্গের খোঁচা দেওয়া চোখ দেখে মুখটা নামিয়ে নিল।
"ভাই, একটা কতা কই রাগ করোস না। তুই বড্ডো ম্যাদামারা। ছোটো থেকে দ্যাখতাসি। এমুন গতর, এমুন গায়ের জোর টাকাও তো কম নাই তালি মেয়েছেলেরে কব্জা করতি পারোস না ক্যান? তুই কি খোজা?"
উঠে দাঁড়ায় তারিনী, পয়সা দিয়ে বলে-
"মেয়ে মানুষ কী করি কব্জা করতি হয় আমি জানি না।"
পিছনে থেকে আওয়াজ আসে, "চরিত্তির খারাপ হলে মেরে বিষ ঝেড়ে দিতি লাগে। বুঝলি"
ইচ্ছে করে ভটভটি না চালিয়ে দাঁড় টেনে ঘাম ঝরিয়ে ঘাটে ফেরে তারিনী। হেঁচড়ে ওঠে পাড়ে। গনগনিয়ে বাড়িমুখো এগোতে থাকে। তাদের বাড়ি নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে পঞ্চাশ মিটার ডান হাতে গেলেই পড়ে। ডান ঘুরতেই দেখে কমলি পাতলা শাড়িটাকে বুকের উপর এক পল্টা করে ফেলে, বুক উঁচিয়ে, নাভি বের করে গাছ জড়িয়ে সাপের মতো বাঁকছে আর নগেন বড়ো একটা মোবাইলে ছবি তুলছে। গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে চোখে রক্ত তুলে নগেনের সামনে এসে দাঁড়াল তারিনী। নগেন প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়ে বলে-
"টিকটক বুঝলি তারিনীদা। তোর বৌরে মোবাইলে দ্যাখোন যাবো। খাঁড়া, শুটিঙটা সারি ফালাই।"
তারিনী কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। নগেন কমলির কোমরে হাত দিয়ে শাড়িটা আরো সরিয়ে দিচ্ছে। ফর্সা ধবধবে গোপন ভাঁজ আর লালায়িত নগেন তারিনীর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আগুনটাকে খুঁচিয়ে দেয়। জারুল গাছের একটা মরা ডাল হাতে নিয়ে ওদের কাছে যায়। দুজনেই ভ্যাবলা হয়ে তাকায়। কিছুক্ষণ পর তারিনীর ঘরের ভেতর থেকে কমলির প্রবল চিৎকার আছড়ে পড়ে নগেনের কানে। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে নিমেষে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যায় নগেন। তারিনীর মা অনেক সাধ্য সাধনা করে তারিনীকে শান্ত করে। দাঁতে দাঁত ঘষে তারিনী বলে-
"আজকের পর ফের যদি নষ্টামি দ্যাখসি সেদিন তুমার গায়ে আর চামড়া থাকবো না। ভালোয় ভালোয় থাকো নয়তো সোজা করনোর ওষুধ আমার জানা আছে।"
দাওয়ায় বসে কার্তিক বলে-
"বিষ ঝারলি দাদা, ঐ দেখ গঙ্গা পাড়ে অশনি সংকেত। প্রকৃতিকে বোঝা যার তার কর্ম নারে। তলে তলে আগ্নেয়গিরি। প্রকৃতির প্রতিশোধ ভয়ংকর।"
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কমলি কার্তিককে দেখে ভালো করে। ঠোঁটের পাশে চুঁইয়ে আসা নোনতা চেটে নেয় জিভে। মাস খানেকের মধ্যে বাড়িটা বাড়ি হয়ে ওঠে। উঠোন ঝকঝকে, দুবেলা রান্না করে সামনে দেয় কমলি। রাতে আদুরে বেড়ালের মতো গিলে নেয় গোটা তারিনীকেই। তারিনী কমলির জিভে লম্বা বরাবর কালো দাগটায় জিভ ছুঁইয়ে আদর রাখে। বুকের কাছে টেনে বলে-
"তুমারে মারতি আমার বুক ফাটি যায়। তুমি আমার বৌ। অন্য পুরুষি তোমায় ছোঁবো ক্যান? কমলি এমুন সোহাগী হয়ে থাকো। পুজায় সোনার দুল দিমু। শাড়ি দিমু। আর ভাইডা পাগলা কিন্তু শিকখিতো। ওরে একটু ছেনহো দিও।"
কমলি হাসে। সকালে শাকসব্জি মাঠ থেকে আনার পর বাজারে বিক্রিরগুলো ঠিক বুঝে বুঝে আলাদা করে যত্নে রাখে। মনে মনে হাসে তারিনী। ঘা পড়লেই মেয়ে মানুষ ঠাণ্ডা। ভালোবাসার কথা বোঝে না। কেবল কার্তিকটা দিন দিন কেমন সিঁটিয়ে যাচ্ছে। কমলিকে দেখলেই কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায়। কমলি কত আদর করে ডাকে-
"আসো, বসো, দাদার লগে কতা কও। ভয় কি হ্যায় তুমারে মারবো না। নাও চা পাউরুটি খাও।"
বর্ষায় গঙ্গা ফুলে ফুলে ওঠে। জল উপচে পড়ে। কার্তিকের সাথে কমলির সম্পর্কটাও সবুজ হতে থাকে। তারিনীর চেহারা ফেরে। বৌকে সাথে নিয়ে মোড়ের মাথায় চপ কিনতে যায়। ঘোমটা দিয়ে চোখ নীচু করে চলে কমলি। কমলির মা, বাবা বাড়ির পুঁইশাক দিতে এসে খুব খুশি হয়ে উঠল মেয়ের ভর ভরন্ত সংসার দেখে। কমলিকে শোবার ঘরে আঙুলের চাপে আটকাল ওর মা-
"তোর খেলাডা এবার কী? ঠিক কইর্যা কতো দেহি। আমার তোর চোখমুখ ভালো ঠ্যাহে না।"
"কি যে কও মা। এই যে দ্যাখসো পিঠের কাটা দাগডা। শুকাতে দিই না। শুকালেই রান্নার খুন্তি দিয়া খুঁচাই।"
"হায়রে তোরে এমুন কইরা মারসে।"
"না মারবো ক্যান? বোঝাইসে হ্যায় সোয়ামি।"
"দ্যাখ মা। হেরা মানুষ খারাপ না। পাগলডাও তো দেহি তোর হাতে হাতে কাজ করে। সব সামলায় রাখ। ঠকবি না। তোর বাপেরে হেইদিন সজল মাস্টারে কলো হ্যাগো যা সোমপত্তি সব কুড়ায় বাড়ায় বিশ লাখ হইবো।"
"কী কও, বিশ লাখ?"
"হ, তাইলে আর কোই কি? সবি তোর ছেলেপুলের। এই পাগলারে তো আর বিয়া করবো না কেউ।"
"ছেলেপুলের? আমার কিসু নাই?"
"আরে পাগলি, যা তোর ছেলেপুলের তাই তো তোর।"
জিলজিলে চোখে কার্তিককে দেখে কমলি। রাতে কুৎ পাখিটা ডাকতেই থাকে। দরজা খুলে বাইরে আসে কমলি। শিকল খুলে কার্তিকের মাথায় হাত রাখে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে কার্তিক। অনভ্যস্ত তানপুরায় দক্ষ হাতে সুর তোলে কমলি। অনভিজ্ঞ কার্তিক অজানা সুখে শরীরের প্রথম পরিচয়ে পানকৌড়ি হয়ে ওঠে। পানকৌড়ির ডূব দেওয়ার নেশা বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। তারপর টানা তিনদিন বৃষ্টি হতেই থাকে।
বর্ষার জল উজিয়ে বাড়ি ফেরে তারিনী। ক্ষেতে জল ঢুকছে তাই বাঁধের ব্যবস্থা করার জিনিস নিয়েই ফিরবে। আকাশে ঘন মেঘ, বেতাল শনশন হাওয়া। ভর দুপুরের গ্রাম যেন শ্মশানের মতো চুপ। বাড়ি ঢুকে ঘরের দিকে তাকাতেই মনে হল যেন একটা ছায়া সরে গেল। দোমনা করেও তারিনী বাড়ির পিছনের গাদাঘর থেকে প্রয়োজনের জিনিসগুলো আগে বস্তায় ভরে নিল তারপর সামনে এসে একটু বসার জন্য দাওয়ায় উঠল। তখনি তীব্র শিৎকারে চমকে উঠল তারিনী। আছড়ে পড়ছে ভাঙছে গোঙাচ্ছে ভীষণ সুখে-
"কমলিইইই!"
চোখের পলকে কার্তিকের উপর থেকে কমলিকে টেনে আছড়ে বেধড়ক মারতে থাকে তারিনী।
"গতরখাগি, তুই আমার ভাইডারেও ছাড়লি না। আইজ তোরে শ্যাষ কইর্যাই দম নিমু।"
কমলি চিৎকার করে বলতে থাকে-
"এই তুমার ভালোবাসা। আমার গায়ের পায়েস গন্ধে তুমার নাকি ন্যাশা লাগে? আর সেই শরীরে তুমার দাদায় মারে তুমি চুপ মারি দ্যাকো, হ্যাঁ।"
"দাদা, মারিস না। ছেড়ে দে। অমন জলের মতো শরীরে মারিস না দাদা।
"কাত্তিক সরি যা। হারামজাদি পুরা সংসারডা নষ্ট করি দিলো।"
"হ, অয় আমারে মারি ফালাক। তুমি দ্যাকো। বাবাগো, উফ্। ও কেতো এই বুকে আর মুখ গুঁজতি পাবা না। আমারে বাঁচাও। ও মা গো!"
কার্তিক ছুটে বাইরে যায় দাওয়ার একপাশে রাখা বঁটিটা এনে দুর্বল হাতে রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাদাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। বলতে থাকে-
"আমি কমলির সাথে ডুববো, তুই আর না করবি না। কমলি আমায় আদর করে মাথায় জল নামে। আমার ভালো লাগে, ভালো লাগে। কমলি ও কমলি।"
তারিনী ভাইকে বাধা দিতে পারে না। কমলি প্রাণপনে হাতদুটো ধরে রাখে ওর। পিছন থেকে আসা আঘাতে রক্তাক্ত তারিনী লুটিয়ে পড়ে। আচমকা শব্দ বদলে যায়। চিৎকার শুরু করে কমলি-
"কে কোথায় আছো গো, পাগলে আমার সোয়ামিরে মারি ফ্যাললো। ও মা, কনো গ্যালেন, ও মা? ও মনা কাকি, জিতেন কাকাআআআ, নিমাই ভাইরে বাঁচা রে আয়রে। ওরে পাগল আমার সব নিলো রে।"
দেখতে দেখতে পাড়ার লোকেরা ছুটে এল। পাগলকে ধরে শুরু হলো মার। কমলির বুক ফাটা কান্নায় কেঁদে উঠল পাড়াসুদ্ধ সকলে। খবর পেয়ে ময়রাবাড়ির সইয়ের সাথে গল্প থামিয়ে হেঁচড়ে এল তারিনীর মা। মৃত রক্তাক্ত তারিনী, আধমরা খুনি পাগল ছেলে আর তার মাঝে বুড়ি দেখল এক যখ বেড় দিয়ে ঘিরে ধরছে তার সব। পাগল কার্তিক হঠাৎ দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থাতেই চিৎকার করে ওঠে-
"মা, পালিয়ে যাও। পালিয়ে যাও। ঠাণ্ডা মন, গরম শরীর, চেরা জিভ, পায়েস গন্ধ মাআআআ। দাদাআআআ। আমার দাদা।"
পুলিশের গাড়ি জল কাদা গর্ত পেরিয়ে তারিনীর বাড়ির গলিতে এসে দাঁড়াল। নৌকাটা দড়ি ছিঁড়ে যে কোন সময় প্রবল স্রোতে ভেসে যাবে এমনটাই দুলছে। অফিসার নৌকাটা ভালো করে দেখল তারপর পা বাড়াল ভেতরে।
অলংকরণঃ কল্লোল রায়
ফেসবুক মন্তব্য