লিভিংরুমে ফোনটা যখন
বেজে উঠলো, রানি তখন
কিচেনে। বাসন মাজছিল।
ফ্রিজের ওপরে রাখা ছোটো
ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে
রানি দেখল, পৌনে তিন।
নির্ঘাত বাচ্চুর ফোন।
দুপুরের খাওয়ার পর এই
সময়টা মাধবী বিশ্রাম
করে। মানে, খাটে গা
এলিয়ে মোবাইল নিয়ে সময়
কাটায়। ফোনের আওয়াজ
চাপা দেওয়ার জন্য রানি
তাড়াতাড়ি বেসিনের ওপর
একটা প্লাস্টিকের মগ
উল্টিয়ে কলটা পুরো খুলে
দেয়। ছড়ছড় করে জলের
আওয়াজ হয়। এ সময়ে আবার
ফোন করার জন্য বাচ্চুর
ওপর খুব রাগ হয় ওর। গত
পরশু ও যখন ফোন করে চলে
আসার জন্য বায়না করছিল,
তখনও রানি খুব বকেছিল।
কিন্তু কথা শুনলে তো!
-- যাও দ্যাখো, তোমার
ফোন। মাধবী বেডরুম থেকে
বলে ওঠে । গলার স্বরে
বিরক্তি স্পষ্ট।
--আমাকে আবার কে ফোন
করবে? রানি গলার স্বর
যথাসম্ভব নিরুত্তেজ
রাখার চেষ্টা করে।
--এই অসময়ে তবে কি আমার
ফোন? আমাকে কেউ ফোন করলে
তো মোবাইলেই করবে।
দ্যাখো, নিশ্চয়ই তোমার
লাটসাহেব। যাও গিয়ে
ফোনটা ধরো, আর এই ঘনঘন,
যখন তখন ফোন করাটা বন্ধ
করতে বলো।
ভিজে হাতদুটো আঁচলে
মুছতে মুছতে রানি কঠিন
মুখে বসার ঘরে আসে।
কিন্তু ক্রিং ক্রিং করে
বেজে চলা ফোনটা দেখেই
ওর বাচ্চুর জন্য মায়ায়
বুকের ভেতরটা টনটন করে
ওঠে। পরশু বড্ড বকাবকি
করেছিল ওকে। ব্যস্ত
হাতে ফোনটা তোলে রানি,
-- হ্যালো, বাচ্চু? বল...
-- মা, মা কোথায়? মাকে
দাও...
--কে, পার্থ বাবা?
বাচ্চুর বদলে পার্থর
গলার স্বরে রানি অবাক
হয়। নিশ্চিন্তও।
--হ্যাঁ হ্যাঁ আমি। রানি
মাসি, তুমি তাড়াতাড়ি
মাকে ডাকো।
--বৌদি, পার্থবাবার ফোন,
শিগগির এসো। রানি
বেডরুমের দিকে মুখ করে
চেঁচিয়ে ওঠে।
--সে কী! ও ভালো আছে তো?
মোবাইলে না করে এখানে
কেন করেছে? বলতে বলতে
মাধবী প্রায় দৌড়ে এসে
ফোনটা নেয়।
-- কী হয়েছে? কোনো বিপদ
হয়নি তো? তুই ভালো আছিস
তো? এক নিঃশ্বাসে মাধবী
বলে।
রানি রান্নাঘরে ফিরে
আসে। ও জানে কারো সঙ্গে
ফোনে কথা বলার সময়
রানির একই ঘরে থাকাটা
মাধবীর পছন্দ নয়। ও
আবার বাসন মাজায় মন
দেয়। ফোনটা বাচ্চুর না
হওয়াতে মনটা অনেক হালকা
লাগে। সমস্ত বাসন মাজা
হয়ে গেলে প্লাস্টিকের
ঝুড়িতে উপুড় করে জল
ঝরতে দিয়ে, বেসিন
পরিষ্কার করে।
ডাস্টারগুলো ভালো করে
ধুয়ে পশ্চিমমুখো
জানালার গ্রিলে মেলে
দিয়ে ও বেডরুমে উঁকি
মারে, কিন্তু মাধবীকে
না দেখতে পেয়ে অবাক
হয়।
--এ কি বৌদি, কী হয়েছে?
পার্থবাবা ভালো আছে তো?
এখানে কেন বসে আছো?
এভাবে? বসার ঘরে যেখানে
টেলিফোন রাখা আছে ঠিক
তার সামনেই দুহাতে মাথা
রেখে বসে রয়েছে মাধবী।
মেঝেতে। রানির কথায় ও
যেন সংবিৎ ফিরে পায়।
রানি ওর কনুই ধরে তুলে
সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে
আবার প্রশ্ন করে,
--কী হয়েছে বৌদি?
পার্থবাবা তো নিজেই ফোন
করল, তবে?
--ও ফোনে কাঁদছিল রানি।
কথাগুলো বলতে গিয়ে
মাধবী যেন নিজেই কেঁদে
ফেলে।
--কেন?
--পার্থ চলে আসতে চাইছে।
উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা
কাল রাতে ওর ওপর
অত্যাচার করেছে, রানি।
এমনকি ওর মোবাইল ফোনটা
পর্যন্ত আটকে রেখেছে।
এখানকার ল্যান্ড
লাইনের নম্বরটাই শুধু
মুখস্থ ছিল বলে পাবলিক
বুথ থেকে লুকিয়ে ফোন
করেছিল। ছেলেটা
কাঁদছিল, বারবার এখানে
চলে আসতে চাইছিল।
--তুমি কী বললে? রানি
প্রশ্ন করে। ওর বুকের
ভেতরে বাচ্চুর মুখ,
কানে বাচ্চুর গলার
আওয়াজ বিনবিন করতে
থাকে।
--আমি আর কী বলব! বলেছি,
আজই ওর বাপির সঙ্গে
কথা বলব। অতগুলো টাকা
খরচ করে সবে ভর্তি করা
হয়েছে, সে কি রাজি হবে!
মাধবী আবার দুহাত দিয়ে
নিজের মাথাটা চেপে
ধরে।
--দেখো, দাদাবাবু কী বলে।
আমি বেরুলাম, দরজাটা
বন্ধ করে দিও।
মাধবী মুখ তুলে রানির
বেরিয়ে যাওয়া দেখে।
লিফ্টের নেমে যাওয়ার
আওয়াজ শুনতে শুনতে
ভাবে, কাজের লোকদের মনে
কোনো মায়াদয়া থাকে না।
পার্থ ওকে সেই ছোটোবেলা
থেকে রানিমাসি বলে ডাকে
অথচ ওর এতবড় বিপদের
খবরটায় রানির যেন কোনো
হেলদোল নেই। মাধবীর
প্রথমে দুঃখ হয়, তারপর
রাগ।
মাধবীকে দেখে রানিরও
প্রথমে দুঃখ ও পরে রাগ
হয়। 'ইস, ঢং দেখ। এখন
নিজের অতবড় দামড়া ছেলে
হস্টেল থেকে চলে আসার
বায়না ধরেছে বলে মেঝেতে
উপুড় হয়ে কাঁদা হচ্ছে।
একেই বলে ধর্মের কল
বাতাসে নড়ে।' মনে মনে
কথাগুলো বিড়বিড় করতে
করতে রানি পাশের
বিল্ডিংয়ে সালভিদের
ফ্ল্যাটের কলিংবেল
টেপে। এখানে ঘর মোছা ও
বাসন মাজার পর পাঁচতলায়
প্যাটেলদের কাজ।
সেখানে আবার কাপড়ও
কাচতে হয়। এই দুই ঘরের
কাজ সেরে রোজ সাড়ে
পাঁচটা নাগাদ রানি ফিরে
আসে মাধবীর কাছে।
ততক্ষণে মাধবীর ভাতঘুম
হয়ে যায়। কোনো কোনোদিন
রানির দেরি হলে মাধবী
দুকাপ চায়ের জল বসিয়ে
দেয়। তারপর সামনের
ব্যালকনিতে বসে দুজনে
চা খায় একসঙ্গে। মাধবী
বসে একটা হাতল লাগানো
উঁচু চেয়ারে, রানি
প্লাস্টিকের স্টুলে।
এই সময়টুকু রানির খুব
ভালো লাগে। দুজনের
মধ্যে আশেপাশের
ফ্ল্যাটের নানান
কেচ্ছাকাহিনি নিয়ে কথা
হয়। মাধবীকে ওর তখন
মনিব নয়, বন্ধু মনে হয়।
এরপর রানির বিশেষ কাজ
থাকে না। বসার ঘরের
মেঝেতে বসে টিভি দেখে।
রাত নটা নাগাদ গৌতম
অফিস থেকে ফিরে এলে
রানি রান্নাঘরে রাতের
রুটি-তরকারি করতে ঢোকে।
সাড়ে দশটায় সবার খাওয়া
মিটলে ওখানে বসেই খেয়ে
নেয়। তারপর রান্নাঘর
পরিস্কার করে মেঝেতে
নিজের বিছানা পাতে
রানি।
নিজের বিছানা পাতার
জন্য একদিন রানির নিজের
ঘরও ছিল। সে যেমনই
হোক। নরেশ, মানে
বাচ্চুর বাবা ডেঙ্গিতে
ভুগে আচমকা মরে যাওয়ার
আগে ওরা থাকত মুম্বইয়ের
উত্তর শহরতলি সন্তোষ
নগরের বস্তিতে। ভাড়া
ঘরে। নরেশ করতো মজুরের
কাজ। রোজ হিসেবে আয়।
কিন্তু ও চলে যাওয়ার
পরে রানির একার পক্ষে
লোকের ঘরে ঠিকে কাজ করে
সেই ঘরের ভাড়া জোগানো,
বাচ্চুকে স্কুলে পড়ানো
আর সম্ভব হচ্ছিল না।
ভাবছিল বাপের বাড়ি
বাসন্তীতে ফিরে যাবে
কিনা। শুনে মাধবীই
একদিন প্রস্তাব
দিয়েছিল,
-- প্রায় দশ বছর ধরে
ঠিকে কাজ করছ আমার
কাছে। আরো এত ঘরে। সবার
সঙ্গে চেনাজানা। ফিরে
গিয়েও তো সেই লোকের
বাড়ি কাজ করতে হবে।
কিন্তু ঐ গাঁয়ে এতো
মাইনে কেউ দেবে?
-- বাপের ঘরে মাথা গোঁজার
জায়গাটুকুতো পাব।
এখানে ভাড়া জোগানো
মুশকিল বৌদি।
-- অন্য আর সব বাড়ি ঠিকে
কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে
তুমি যদি আমার এখানে
রান্নাটাও করে দাও,
তাহলে এখানেই রাতে
থাকতে পারো। দুবেলা
খাওয়াও পাবে। তবে নগদ
মাইনে বেশি দিতে পারবো
না।
-- কিন্তু বৌদি আমি তো
একা নই। আমার ছেলে
বাচ্চুও তো আছে।
-- বারো-তেরো বছরের
ছেলেকে তো বড়ই বলা
চলে। মুম্বইয়ের অনেক
বড়লোকের বাড়িতেই
ফাইফরমাশ খাটার জন্য
এমন ছেলে কাজে রাখে।
তোমার ছেলেও ভালো
থাকবে, আবার ওর মাইনের
টাকা জমলে চার পাঁচ বছর
বাদে বস্তিতে একটা
চালি-টালিও কিনতে
পারবে।
এই প্রস্তাবটা প্রথমে
রানির কেন জানি একদম
ভালো লাগেনি। বাচ্চুকে
ছেড়ে থাকার কথা ও
ভাবতেও পারে না।
সারাদিন বাদে দশ ঘরে
কাজ সেরে ফিরে ছেলেটাকে
কাছে পেয়ে ওর সব
পরিশ্রম যেন হালকা হয়ে
যেত। কিন্তু
সপ্তাহখানেক বাদে
মাধবী আবার এই প্রসঙ্গ
তুলেছিল।
-- তোমার দাদাবাবুর চেনা
এক পরিবার। পেডার রোডে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই
খুব বড় চাকরি করে। ওদের
ঠিকে রান্নার লোক, অন্য
সব কাজের লোকও আছে।
তবু সারাদিন বাড়িতে
থাকার জন্য একটা ছোটো
ছেলে খুঁজছে। আসলে ওদের
একটা সতেরো আঠেরো বছরের
ছেলে আছে। বাড়িতে একটা
ছেলে থাকলে তারও সঙ্গী
হয়।
-- কিন্তু বৌদি তাহলে তো
বাচ্চুর স্কুল ছেড়ে
দিতে হবে। ছেলেটার
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।
রানির কন্ঠস্বরে
দ্বিধা।
-- ভেবে দ্যাখো কী করবে।
তাছাড়া ওই অবৈতনিক
স্কুলে কী বা পড়াশোনা
হয়! তাও আবার মারাঠি
মিডিয়াম।
-- মাইনে কত দেবে? রানি এই
ভেবে প্রশ্নটা করে যদি
কম মাইনের অজুহাতে
বৌদির প্রস্তাবটা
প্রত্যাখ্যান করা
যায়।
--খাওয়া-পরা ছাড়াও তিন
হাজার টাকা। প্রতি
মাসে। তোমার দাদাবাবু
না হয় ওখানকার কোনো
সরকারি স্কুলে ভর্তি
করে দেওয়ার কথা বলে
দেবে।
যাওয়ার দিন রানিকে
দু’হাতে জড়িয়ে ধরে
বাচ্চু খুব কেঁদেছিল।
রানিও। বাচ্চুকে
পাঠিয়ে দিয়ে রানি এসে
উঠেছিল মাধবীর
ফ্ল্যাটে। নিজের বলতে
যেটুকু জিনিসপত্র
জমেছিল সবই প্রায় জলের
দরে বিক্রি করে দিতে
হলো রাখার জায়গার
অভাবে।
প্রথম ক'দিন দাদাবাবুই
অফিস থেকে ফিরে খবর দিত
যে বাচ্চু ভালো আছে।
যাওয়ার দিন পনেরো বাদে
মাধবী একবার নিজের
মোবাইল থেকে ওই বাড়ির
নম্বর লাগিয়ে বাচ্চুর
সঙ্গে কথাও বলিয়ে
দিয়েছিল। সেদিন ফোনেও
বাচ্চুর গলা শুনে ওকে
বেশ খুশিই মনে হয়েছিল।
কম্পিউটারে কেমন সব গেম
খেলতে শিখেছে সেসব
বর্ণনা দিচ্ছিল
উত্তেজিত হয়ে। মাধবী
রানিকে বলেছিল, ওকে
এখানকার ল্যান্ড
লাইনের নম্বর দিয়ে দাও।
খুব দরকার পড়লে তোমার
সঙ্গে কথা বলতে পারবে।
এর কদিন বাদেই পার্থও
ভর্তি হলো
ব্যাঙ্গালোরের একটা
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।
গৌতম গিয়েছিল ওকে
হোস্টেলে রেখে আসতে।
হোস্টেলে যাওয়ার দুদিন
আগে রানি ভালো মন্দ
অনেককিছু রান্না
করেছিল। পার্থর অনেক
বন্ধু বান্ধব
নিমন্ত্রিত ছিল সেদিন
সন্ধ্যায়। খুব হইচই
করেছিল সবাই মিলে।
অনুষ্ঠানের শেষে
রান্নাঘরের মেঝেতে একা
শুয়ে সেদিন রানির খুব
মন খারাপ করছিল বাচ্চুর
জন্য।
মাস দুয়েক বাদে হঠাৎ
একদিন দুপুরে বাচ্চু
ফোন করে।
ল্যান্ডলাইনে।
-- মা আমি বাড়ি যাব।
--.আমাদের কোনো বাড়ি নেই।
আমিই অন্যের বাড়ি থাকি,
তুই জানিস না?
-- আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
বাচ্চু আবার বলেছিল।
-- কেন এক কথা বলছিস? তোর
কী অসুবিধা হচ্ছে
ওখানে? খেতে দেয় না ওরা?
বকাবকি করে? মারধর?
-- না।
-- তবে?
-- আমি এখানে থাকব না।
আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
-- না, তুই ওখানেই থাকবি।
রানি ফোন রেখে
দিয়েছিল।
দুদিন বাদেই দুপুরে
আবার ফোন করেছিল
বাচ্চু। সেদিন ফোন
ধরেছিল মাধবী। রানি কথা
বলে ফোন রেখে দেওয়ার পর
মাধবী ভ্রূ কুঁচকে
প্রশ্ন করেছিল,
-- গত পরশুই তোমাকে ফোন
করেছিল না?
-- হ্যাঁ, চলে আসার জন্য
বায়না করছে। রানির
কুণ্ঠিত উত্তর।
-- বড্ড আতুপাতু করে বড়ো
করেছ ছেলেকে। এতবড় ছেলে
বায়না করলেই হল। মাধবী
বলেছিল।
কিন্তু তিন চারদিন বাদে
বাচ্চু আবারও ফোন
করে,
-- এ বাড়ির দাদাটা আমার
গাল টেপে, আমাকে চুমু
খায়।
-- তাতে কী হয়েছে? তোর
নিজের দাদা হলে খেত না?
রানি বলে।
-- না। আমার ভালো লাগে
না। আমাকে নিয়ে যাও।
আমিও তোমার সঙ্গে কাজ
করব।
-- পাগলামি করিস না বলছি।
এত টাকা মাইনের কাজ
কোথায় পাবি? কে তোকে
কম্পিউটারে খেলতে দেবে?
বাচ্চুর আবদার রানি
প্রশ্রয় দেয়নি।
-- তোমার ছেলে দুদিন বাদে
বাদে ফোন করে কেন? মাধবী
বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন
করেছিল।
-- ওই একই বায়না। চলে
আসতে চাইছে।
-- চলে এলে থাকবে কোথায়?
এতবড় ছেলে নিজের
ভালোমন্দ বোঝে না! ওকে
এত লাই দিও না রানি।
না। রানি লাই দেয়নি।
বাচ্চু যতই বায়না করুক
ওকে ওখানেই থাকতে হবে।
রানিকে শুধু একটা
সস্তার মোবাইল ফোন কিনে
নিতে হবে, যাতে বাচ্চু
কথা বলতে পারে।
সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে
রানিকেই চা বানাতে হয়।
মাধবী ব্যালকনিতে
বসেছিল। বিমর্ষ।
অভ্যাসমতো রানি দুকাপ
চা নিয়ে সামনের স্টুলে
বসলেও আজ আর কোনো কথা
বলে না মাধবী। রাতে
রুটি বানাতে বানাতে
রানি উৎকর্ণ হয়ে বসার
ঘরে গৌতম ও মাধবীর কথা
শোনার চেষ্টা করে।
-- তুমি খেপেছ নাকি?
অতগুলো টাকা খরচা করে
ভর্তি করলাম। ফিরে আসবে
বললেই হল? গৌতমের গলা
গম্ভীর ও বিরক্ত।
-- ও কাঁদছিল গো। ও ভয়
পাচ্ছে ওখানে থাকতে।
-- বড্ড আতুপাতু করে বড়ো
করেছ ছেলেকে।
রানির হাসি পায়।
কয়েকদিন আগে বৌদি ওকে
ঠিক এই অভিযোগই
করেছিল। স্টোভের ওপর
টোস্টারে রুটি সেঁকতে
সেঁকতে ওর বাচ্চুর কথা
মনে পড়ে যায়। উনুন থেকে
নামানো গরম রুটিতে নাক
ঠেকিয়ে গন্ধ শুঁকতো
বাচ্চু।
পরের দিন রানি যখন ঘর
ঝাঁট দিচ্ছে , ফোনটা
আবার বেজে ওঠে। মাধবী
তখন সবে স্নান করতে
ঢুকেছিল। ফোনের আওয়াজ
শুনে কোনোরকমে গায়ে
ভিজে কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে
আসে। রানিও ঝাঁটা ফেলে
রেখে যাচ্ছিল ফোন ধরতে।
মাধবীকে দেখে ও দাঁড়িয়ে
যায় বসার ঘরের দরজার
পাশে। মনে মনে
প্রার্থনা করতে থাকে,
ফোনটা যেন বাচ্চুর না
হয়।
-- হ্যালো, পার্থ? মাধবী
ফোনে প্রায় চিৎকার করে
ওঠে।
রানি দরজার পাশ থেকে
সরে এসে আবার ঘর ঝাঁট
দেওয়ায় মন দিতে চেষ্টা
করে। যদিও কান থাকে
বসার ঘরের দিকে।
-- না বাবা, কোনো চিন্তা
নেই। তোর বাপি বলেছে
তেমন হলে নিজে গিয়ে
প্রিন্সিপ্যালের
সঙ্গে কথা বলবে।
-- তোর মোবাইল ঠিক ফেরত
দিয়ে দেবে। অবুঝ হোস না
বাবা। তুই তো আমার সোনা
ছেলে।
-- তুই কাঁদলে আমার কষ্ট
হয়, বুঝিস না?
মাধবীর কথা কানে আসে
রানির। শোওয়ার ঘর ঝাঁট
দিয়ে ও দাঁড়িয়ে থাকে
বসার ঘরের দরজার ধারে।
চুপ করে দেখতে থাকে
মানুষটাকে। স্নানঘর
থেকে বেরিয়ে আসা মাধবীর
মুখে গলায় জমে থাকা
বিন্দু বিন্দু জলের
সঙ্গে মিশে যাচ্ছে
দু-চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া
জলের ধারা।
-- একটু সহ্য করে থাক
বাবা। তোর বাপি তো
কিছুতেই মানতে চাইছে
না। পার্থ...! পার্থ...!
মাধবী অবাক চোখে
রিসিভারটার দিকে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,
যথাস্থানে নামিয়ে
রাখে। ঘুরে দাঁড়াতেই
রানির সঙ্গে চোখাচোখি
হয় ওর। চোখ সরিয়ে নেয়
রানি।
-- রাগ করে ফোন রেখে দিল।
আজও ছেলেটা কাঁদছিল।
মাধবী যেন স্বগতোক্তি
করে।
-- দাদাবাবুকে বলো না
পার্থবাবাকে নিয়ে
আসতে। রানি বলে। ঝাঁট
দিতে দিতে। যেন পাড়ার
স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে
আসতে বলছে। উদাসীন
স্বরে।
-- তোমার দাদাবাবু মানলে
তো। সব কলেজেই নাকি
একটু আধটু এমন হয়।
-- তাহলে আর তুমি অযথা
চিন্তা করছ কেন বৌদি।
ছেলেপুলেকে বেশি
আতুপুতু করা ভালো নয়।
রানি সোজা চোখ রাখে
মাধবীর চোখে। এবার
মাধবী চোখ সরিয়ে
বাথরুমে ঢুকে যায়।
পরপর বেশ কয়েকদিন আর
কোনো ফোন আসে না।
প্রতিদিনের নিয়মমতো
রানির সময় কেটে যায়।
শুধু সন্ধ্যাবেলা
ব্যালকনিতে একসঙ্গে চা
খাওয়ার সময় বৌদিকে যেন
আর আগের মতো বন্ধু মনে
হয় না। বৌদি যেন এখন
শুধুই মনিব। কথাবার্তা
যেটুকু হয় শুধুই
কাজের।
সপ্তাহখানেক বাদে
একদিন সন্ধ্যা ছ-টা
নাগাদ রানি এবং মাধবী
ব্যালকনিতে বসে চা
খাচ্ছে, হঠাৎ ঝনঝন করে
ল্যান্ডফোনটা বেজে
ওঠে। রানি ও মাধবী
দুজনেই পরষ্পরের দিকে
তাকায়। দুজনের চোখেই
উদ্বেগ। দুজনেই হাতের
কাপ নামিয়ে রেখে উঠে
দাঁড়ায়। দুজনেই
একসঙ্গে দ্রুত পায়ে
এগিয়ে যায় বসার ঘরের
দিকে। দরজার কাছে পৌঁছে
দাঁড়িয়ে যায় রানি।
মনে মনে প্রার্থনা করতে
থাকে ফোনটা যেন
পার্থবাবার হয়।
-- হ্যালো, পার্থ? মাধবীর
উদগ্রীব স্বর।
তারপর ফোনের রিসিভারটা
টেবিলে নামিয়ে রেখে
ঘুরে দাঁড়ায় মাধবী।
রানির দিকে তাকিয়ে
বলে,
-- বাচ্চুর ফোন। কথা
বলো।
রানি এগিয়ে এসে ফোন
তোলে।
-- কিরে, কী হয়েছে? ভ্রূ
কুঁচকে একবার ডান কানে,
একবার বাঁ কানে রিসিভার
বদলে বাচ্চুর কথা শুনতে
থাকে।
-- আবার এক কথা। না না না,
আমি বলেছি না, তোকে
ওখানেই থাকতে হবে। এক
নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে
রানি।
-- কী হয়েছে? তোর নুংকুতে
হাত দেয়? দিক! তাতে কী
হয়েছে? তোর জাত গেছে? তুই
না ছেলে!
রানি ওর পিঠে মাধবীর
হাতের স্পর্শ পায়।
-- দ্যাখো তো বৌদি, এতবড়
ছেলে কেমন মেয়েদের মতো
কাঁদছে। চোয়াল শক্ত করে
বলে রানি। ওর পিঠে হাত
রেখেই মাধবী বলে,
-- ওকে নিয়ে এসো রানি।
-- তুমি কী বলছো, বৌদি...,
রানির গলার স্বর যেন
বুজে আসে।
রানির হাত থেকে রিসিভার
টেনে নিজের কানে নিয়ে
মাধবী বলে ওঠে,
-- বাচ্চু, কাল সকালেই
তোর মা গিয়ে তোকে নিয়ে
আসবে বাবা। একটা রাত
একটু কষ্ট করে থাক।
ফোনটা সজোরে রেখে দেয়
মাধবী। ওর দুহাত কাঁপতে
থাকে এক অব্যক্ত
ক্রোধে। দু চোখ যেন
রক্তবর্ণ। দাঁত চেপে ও
বলতে থাকে,
-- আমি ঐ বদমায়েশ
ছেলেটাকে ছাড়ব না। এর
শেষ দেখেই ছাড়ব। দরকার
পড়লে পুলিশে যাব।
রানি অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকে ওর বৌদির মুখের
দিকে। এ মুখ ও চেনে না।
আগে কখনও দেখেনি। এ মুখ
বৌদির নয়, বন্ধুর নয়,
মনিবেরও নয়।
এ যেন শুধুমাত্র এক
মায়ের মুখ।
অলংকরণঃ অর্ঘ্য দত্ত
ফেসবুক মন্তব্য