শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ,
গবেষক, লেখক,
শিশুসাহিত্যিক,
নাট্যকার, অভিনেতা,
গায়ক। এতগুলো ক্ষেত্রে
বিচরণ করে এসেছেন। এরকম
versatile মানুষ খুব কম দেখা
যায়! আজ আপনার কাছ থেকে
অনেক কিছু জানার ইচ্ছে।
শুরু করা যাক আপনার
ছোটবেলার কথা।
আমার ছোটবেলা কেটেছে
এখনকার বাংলাদেশের
ঢাকা জেলার গ্রামে।
গ্রামের নাম ঠাকুরবাড়ি
পঞ্চাশ, এখন যাকে
ধামরাই নামে শহর গ্রাস
করে নিয়েছে। আমার
গ্রামে একটি নদী ছিল,
তার নাম বংশাই। তারই
ধারে ছিল আমাদের
পাঠশালা আর খেলাধুলোর
জায়গা। পরে ধামরাই
হার্ডিঞ্জ হাই স্কুলে
ক্লাস ফোরের অর্ধেক
পর্যন্ত পড়ি। তার পর
সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিম
বাংলায় খড়গপুর শহরে চলে
আসি। সেখানে আমার
ক্লাস ফাইভ থেকে নতুন
করে পড়া শুরু হয়।
আমার পারিবারিক
সংস্থানে বৈচিত্র্য
ছিল। আমি পোষ্যপুত্র
হিসেবে জন্মের পরে অন্য
এক পরিবারে চালান হয়ে
যাই, সেখানে আমার পালক
পিতা আমার দুই পিসিমাকে
বিবাহ করেছিলেন। তাঁরা
আমার ‘বড়মা’ আর ‘ছোটমা’
হন। তাঁরাই অনেকাংশে
আমার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে
এসেছেন। আমার
ছাত্রজীবনের প্রথম
দিকে আমার ছোটমার
সস্নেহ শাসন-তাড়নই ছিল
আমার এগিয়ে চলার মূল
শক্তি। লেখাপড়ায়
ক্লাসে উপর দিকে
থাকতাম, কিন্তু নিজেকে
‘ভালো ছেলে’ বলে কখনও
মনে হয়নি। উদ্বাস্তু
হয়ে খড়গপুরে এসে (১৯৪৭)
কিশোরবয়সে প্রচুর
হিন্দি সিনেমা দেখতাম,
আবার স্কুলের ছাত্র
অবস্থাতেই বামপন্থার
দিকে ঝুঁকে পড়ি।
ছেলেবেলা থেকেই গান
গাইতে খুব ইচ্ছে হত, সে
ইচ্ছেটা এখনও বজায় আছে।
ছোটবেলায় আপনার জীবনে
সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছেন
যিনি তাঁর কথা।
দ্যাখো, আমার পরিবারের
শিক্ষাদীক্ষার মান খুব
উঁচু ছিল না। আমার পালক
পিতা (নিজের পিতাও)
ছিলেন মাইনর, অর্থাৎ
ক্লাস সিক্স পাশ, আমার
মায়েরা (তিন মা) নাম সই
করতে পারতেন মাত্র। আমি
কী হব, সে সম্বন্ধে কোনও
পরিকল্পনা করার
সামর্থ্য আমার
পরিবারের ছিল না, এখন
যেমন থাকে। আমি স্কুলে
যাচ্ছি, মোটামুটি ভালো
ফল করছি, এতেই তাঁরা
সন্তুষ্ট থাকতেন।
গ্রামে শৈশবে একজন
গৃহশিক্ষক ছিলেন, বাবার
মুহুরি শ্রী অমূল্য
আচার্য—তিনি আমার ভালো
ছেলে হওয়ার ভিত তৈরি
করে দিয়েছিলেন। বই পড়ার
আগ্রহও ছেলেবেলাতেই
তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার
এক খুড়তুতো বোনের
স্বামী, গণেশ
জামাইবাবু, কলকাতা থেকে
মৌমাছির
‘জ্ঞানবিজ্ঞানের
মধুভাণ্ড’ প্রথম খণ্ড
এনে দিয়েছিলেন, সেটা
আমি প্রায় রোজই
নাড়াচাড়া করতাম। তা
আমাকে বুঝিয়েছিল কত কী
জানবার আছে পৃথিবীতে।
আর দেশভাগের পরে
খড়গপুরে অতুলমণি হাই
স্কুলের শিক্ষক
হিতেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ
বর্মন, বঙ্গবাসী কলেজে
জগদীশ ভট্টাচার্য,
বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রমথনাথ বিশী ও নারায়ণ
গঙ্গোপাধ্যায়,
যাদবপুরে সহকর্মী
দেবীপদ
ভট্টাচার্য—এঁরা
আমাকে নানাভাবে
প্রভাবিত করেছেন। কেউ
স্বাধীন সৃষ্টিশীল
রচনায়, কেউ সমালোচনা আর
বিচারে, কেউ অধ্যাপনার
আদল তুলে ধরতে, এবং কেউ
অন্যান্য ক্ষেত্রে,
আমার আগ্রহের
বিস্তারে। তবে খড়গপুরে
বখে যাওয়ার হাত থেকে
আমায় বাঁচিয়েছিলেন
পাড়ার দাদা জয়রামদা
(সুনীল দাস), যিনি ক্লাস
সেভেনে আমাকে মাথার চুল
উলটে আঁচড়াতে (অভিনেতা
অশোককুমারের চুল দেখে
মুগ্ধ হয়ে) দেখে
বকেছিলেন, আর নিজের
পকেটের পয়সা দিয়ে পাড়ার
মিলন মন্দির
লাইব্রেরিতে ভর্তি করে
দিয়েছিলেন। এই
লাইব্রেরিরও আমার
জীবনে একটা বড় ভূমিকা
আছে।
ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ
হিসেবে আপনি অগ্রগণ্য।
ভাষাবিজ্ঞানের জন্য
আমাকে প্ররোচিত করেন
দেবীপদ ভট্টাচার্য।
তাঁর আগ্রহে আমি ১৯৬৭
সালে আন্নামালাইয়ে
ভাষাবিজ্ঞানের সামার
স্কুল করি, পরের বছর
বরোদায়। তার পর
ফুলব্রাইট পেয়ে
শিকাগোতে গিয়ে পাঠ আর
গবেষণা শেষ করি।
শিক্ষাবিদ হওয়া মূলত
শিক্ষাপ্রশাসনে আসার
পর (রবীন্দ্রভারতীর
উপাচার্য হই ১৯৯০-এ),
আসলে শিক্ষার
তাত্ত্বিক বিষয়ে
পড়াশোনাও তখনই শুরু হয়।
কিন্তু ভাষা আর শিক্ষা
নিয়ে চিন্তা ১৯৮০ থেকেই
শুরু হয়েছিল, যখন
পশ্চিমবাংলায় ইংরেজি
কখন শেখানো হবে এ নিয়ে
বিতর্ক শুরু হয়।
শিক্ষার লক্ষ্য, ভারতে
শিক্ষাব্যবস্থা,
শিক্ষায় মনোবিজ্ঞান,
পাঠক্রম ইত্যাদি নিয়ে
তখন পড়াশোনা আর
লেখালেখি শুরু করি।
সবকিছুতেই ভাষার প্রতি
কিছু ভালোবাসা দেওয়ার
চেষ্টা করেছি।
আপনি একজন সুপরিচিত
শিশুসাহিত্যিক! নাটকের
সঙ্গেও আপনি
ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে
বলব, ছড়া-টড়া ইত্যাদি
লেখা আমার স্কুল জীবনেই
শুরু হয়। ১৯৫৮-তে
সম্ভবত আনন্দবাজার
পত্রিকা-র ছোটদের পাতা
‘আনন্দমেলা’য় প্রথম
ছড়া বেরোয়। পরে এখন
লুপ্ত যুগান্তর
পত্রিকায় বিখ্যাত লেখক
প্রফুল্ল রায় আমাকে
দিয়ে ছোটদের (এবং বড়দের)
জন্য নানা ধরনের লেখা
লেখান, মাসিক
আনন্দমেলা-র সম্পাদক
কবি নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তীও আমার একজন
প্রধান উৎসাহদাতা
ছিলেন। নাটক করায় আমার
আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন
শচিন সেনগুপ্তের
কনিষ্ঠ পুত্র
দীপেন্দ্রনাথ
সেনগুপ্ত, পরে অজিতেশ
বন্ধোপাধ্যায় তাকে
পুষ্ট করেন। আমার প্রথম
গুরুত্বপূর্ণ বই নাটক
বিষয়েই। জানি না, কৈশোর
থেকেই একটা বহুমুখী
প্রবণতা ছিল, এবং পরে
আমি যখন বুঝলাম যে
মানুষের মধ্যে একাধিক
সম্ভাবনা থাকতেই পারে
তখন এই Jack of all trades হওয়া
নিয়ে কোনও অপরাধ বোধ
করিনি।
অজিতেশ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে অভিনয় করার
অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়েছে
আপনার। ওঁর সম্বন্ধে
কিছু বলুন। (আপনার বই
যারা পড়েনি তাদের
জন্য)
অজিতেশের গল্প আমি আমার
‘নাটমঞ্চ নাট্যরূপ’
বইয়ে করেছি। এত প্রবল
‘এনার্জি’ আমি খুব কম
লোকের মধ্যে দেখেছি।
হাসতেন হা-হা-হা করে
আকাশ কাঁপিয়ে, রেগে
উঠতেন গর্জন করে, তখন
আমরা ভয় পেয়ে যেতাম, আর
ভুল কারণে কারও ওপর রাগ
করলে সেটা বুঝতে পেরে
পরক্ষণেই জিভ কেটে
নিজের কান মুলতেন। তখন
আমরাই লজ্জায় মরে
যেতাম। যখন কারও সঙ্গে
কথা বলতেন তখন মনে হত
শ্রোতা অজিতেশের কাছে
পৃথিবীর সব চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ লোক। তার
হাত ধরে, কাঁধে হাত দিয়ে,
‘আরেদ্দাদা!’ বলে
অদ্ভুত একটা কাণ্ড
করতেন। প্রচুর গল্প
করতেন, গ্রামীণ
গল্প—যেমন জমিদারের
বংশের ছেলের প্রথম
ম্যাত্রিকুলেশন (নাকি
এমএ) পরীক্ষা দেওয়ার
গল্প। বা শ্বশুর আর
জামাইয়ের ভাইয়ের গল্প।
সেটা বলি। বর্ষায়
জলভর্তি রাস্তায় ছপছপ
করে যাচ্ছে একজন,
শ্বশুর হেঁকে বললেন,
‘কে যায়, জামাই নাকি?’
এখানে শ্বশুর ‘যায়’ আর
‘জামাই’ দুটোই ইংরেজি
z’ দিয়ে বলেছিলেন।
জামাইয়ের ভাই উত্তর
দিল, ‘আইজ্ঞেঁ পেরায়।’
অসম্ভব ছিল রসিকতার
ভাণ্ডার। কিছু
কুসংস্কারও ছিল, যেমন
রেলগাড়িতে গাড়ি যে দিকে
যাচ্ছে তার উলটোমুখে
শুয়ে ঘুমলে নাকি ব্লাড
প্রেশার হয়। নেতৃত্বের
একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা
ছিল ওঁর, প্রতিভার কথা
তো ছেড়েই দিলাম। আমার
মতো লোককে দিয়েও ভালো
অভিনয় করিয়ে নিতে
পারতেন।
সিনেমায় অভিনয় করতে
চান নি? সুযোগ এসেছিল
কখনও?
একটা ছোট পাঁচ মিনিটের
ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম,
সেটা কলকাতা দূরদর্শনে
দেখানো হয়েছে।
স্কুলশিক্ষকের
চরিত্র। তার পরেও এ রকম
ছোটখাটো অভিনয় করেছি,
সেগুলি বলবার মতো কিছু
নয়। তবে কোনও সিনেমার
নাম মনে নেই।
আপনার গান ছাত্র
অবস্থায় আমাদের মুগ্ধ
করে! আপনার অ্যালবাম
‘কেটেছে দিন’ জানি। আর
কোনও অ্যালবাম আছে কি?
গান আমি
প্রথাসিদ্ধভাবে
শিখিনি বললেই চলে। মাঝে
মধ্যে দু-একজন ডেকেছেন,
কিন্তু বসে থাকতে
পারিনি। আসলে আমার
‘জিন’-এ কোথাও একটা
গানের ইচ্ছে ছিল, এক সময়
গলায় কিছু সুরও হয়তো
ছিল। আমার জন্মদাতা গান
গাইতে পারতেন, গান
লিখতেনও। আমার সব
মিলিয়ে দুটি অ্যালবাম
হয়েছে, ভাবনা রেকর্ডস
অ্যান্ড ক্যাসেট থেকে।
একটি বোধ হয় ইউটিউবে
আছে। সব গান সমান
উতরোয়নি।
আপনার লেখা নকল করা
নিয়ে গল্পটা যদি বলেন।
বোধহয় বছর দশেক আগে হবে,
আমার লেখা নকল করে
গবেষণায় নিজের বলে
চালিয়েছিল বর্ধমানের
এক অধ্যাপক, সে এখন
যথারীতি প্রফেসর হয়ে
গেছে, শাসকদের স্নেহে।
তার উন্নতি হয়েছে, তবে
আমার কোনও ক্ষতি হয়নি।
বাংলা না হলে আর
কি?
আমি বাংলাভাষাকেই আমার
প্রধান প্রকাশের বাহন
করেছিলাম, বিদেশে যাওয়া
এবং সেখানে চাকরি নিয়ে
থেকে যাওয়ার সুযোগ
সত্ত্বেও ফিরে এসে—এই
ভাবনা থেকে যে, আমার
ভাষায় ছেলেমেয়েদের আর
সাধারণ মানুষের নানা
জরুরি কথা সহজ আর সরস
ভাষায় লিখে জানানোই হবে
আমার ব্রত। একটাই জীবন,
তাতে এটাই আমার
অগ্রাধিকার ছিল।
আপনি ছিলেন আমাদের
বন্ধু, কাছের জন। আপনি
কি বরাবরই এভাবে
ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে
মিশতেন নাকি সেটা বাইরে
থেকে ঘুরে আসার প্রভাব?
আমরা আপনাকে ওই
সময়টাতেই পেয়েছিলাম
তাই জিজ্ঞেস করছি।
আজকের যাদবপুর
সম্বন্ধে আপনার
মন্তব্য।
ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু
আমি বিদেশ যাওয়ার আগেও
ছিলাম, কারণ আমি নিজে
একটু informal স্বভাবের লোক।
বিদেশ থেকে ঘুরে এসে
হয়তো সেটা আরও পোক্ত
হয়েছিল। আমি তো গোড়া
থেকেই তাদের নিয়ে
পিকনিকে গেছি, বেড়াতে
গেছি, সর্বক্ষণ চেঁচিয়ে
গান গেয়েছি, হিন্দি,
ইংরেজি, কোঙ্কনিজ সব
ধরনের গান। তারা যখন
আমার সঙ্গে গলা মেলাত
তখন মনে হত এ জীবনটা
মন্দ নয়। যাদবপুরে সে
সম্পর্ক এখনও আছে বলে
মনে হয়। এখন তো
ছাত্রছাত্রীরা
যাদবপুরেও শিক্ষকদের
নামের সঙ্গে ‘দা’ জুড়ে
দেয়, শান্তিনিকেতনের
মতো। আমার সেটা ভালোই
লাগে।
বৌদির সঙ্গে আপনার
আলাপ, প্রেম (আপনার বই
যারা পড়েনি তাদের
জন্য) এবং আপনাদের এমন
কোনও ঘটনা যা আগে কখনও
বলেননি।
আমার স্ত্রী এমএ ক্লাসে
আমার সহপাঠিনী ছিলেন।
তিনি প্রেসিডেন্সির,
আমি নিম্নমধ্যবিত্ত
বঙ্গবাসীর। তাঁর আগে
আরও দু-একজনের সঙ্গে
প্রেমে পড়ার চেষ্টা
করেছিলাম, একজনের সঙ্গে
(আমার খড়গপুর কলেজের
সহপাঠিনী) কিছুটা
এগিয়েছিলামও। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত মৈত্রেয়ী
বন্দ্যোপাধ্যায়ে এসে
ভিড়লাম। তবে প্রচুর
উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে
তাঁকে পেয়েছিলাম।
মাহিষ্যের ছেলের পক্ষে
কুলীন বামুনের কন্যাকে
অর্জন করা তখন সহজ ছিল
না। এখন কতটা সহজ হয়েছে
জানি না।
আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে
যে কথাগুলি মনে পড়ে তার
মধ্যে একটি—এক বার একটি
ঝুটো মুক্তার ব্রোচ,
দাম মাত্র তিন ডলার,
তিনি কিনতে চেয়েছিলেন।
সেটা আমি কিনে দিতে
পারিনি তখন, কারণ তখন
আমার একটু সমস্যা
চলছিল। পরে তাঁকে অনেক
দামের গহনা কিনে
দিয়েছি, কিন্তু সেই
দুঃখটা তাঁর মনে ছিল।
আমারও মনে তাই নিয়ে
অপরাধবোধ আছে, তাঁর
দুঃখটা আমারও দুঃখ হয়ে
আছে।
তাঁর কাছ থেকে অনেক
বিক্রমপুরিয়া
বাগ্ধারা শিখেছি।
যেমন আনাড়িভাবে কাউকে
কাজ করতে দেখলে তিনি
বলতেন, ‘লুল্লু হাত
গোবর পোঁদে’; পুরোনো
দিন চলে গেছে বোঝাতে
বলতেন, ‘হয় হব দিন বাগে
খাইয়া ফালাইসে’। কেউ
অভিমান করার পর আবার
ভাব জমাতে চাইলে বলতেন,
‘মনা, অল্পে অল্পে ঘনা !’
এই রকম অনেক কিছু। তাঁর
বড়দি একবার তাঁদের
স্কুলের কী একটা উৎসবে
গিয়ে ফিরে বললেন, ‘কত কী
খাওয়াইসে। মিষ্টি,
অমলেট-টমলেট!’ এই
‘অমলেট’ কী তারা জানত
না, বাড়িতে তারা যা খেত
তা হল ‘মামলেট’। দুটো
টয় একই জিনিস, তাও তারা
জানত না। তখন তারা
দিদিকে জিজ্ঞেস করল,
‘হ্যাঁ রে দিদি, মামলেট
ত জানি, এই ‘অমলেট’টা
কীরকম খাইতে?’ বড়দি
বললেন, ‘এই আমাগ
মামলেটের মতই, তবে একটু
নরম নরম, আর একটু
মিষ্টি-মিষ্টি !’
দেশবিভাগ, রিফিউজি,
CAA, NRC - আপনার
মন্তব্য।
দেশবিভাগ হয়েছিল
নেতাদের ক্ষমতাভাগের
জন্যে, কে রাষ্ট্রের
প্রধান হবে, তাই নিয়ে।
আমি উদ্বাস্তু হিসেবে
তারই শিকার। আমি কোথাও
একটা পৌঁছেছি, আর হাজার
হাজার দু-সম্প্রদায়ের
মানুষ ধ্বংস হয়ে
গেছে—সম্মানে, জীবনে।
CAA, NRC আবার সেই ইতিহাসের
পুনরাবৃত্তি করতে
চলেছে। এ সব ঠেকাতেই
হবে।
বর্তমান পরিস্থিতির
প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করব,
যদি আপনি ওখানে না
জন্মাতেন তবু কি ঢাকা
আজ আপনার সঙ্গে সমান
আন্তরিকতা দেখাত?
আমি ঢাকায় জন্মেছি,
শুধু এই কারণে
বাংলাদেশের মানুষ
আমাকে ভালোবাসে তা বললে
তাঁদের ছোট করে দেখা
হয়। আমি তাঁদের
ভালোবাসি বলেই তাঁরাও
আমাকে দ্বিগুণ
প্রতিভালোবাসা দেন।
আমি তো বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের জন্যে
কিছু কাজও করেছিলাম,
যার ফলে সেখানকার সরকার
আমাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের
বন্ধু’ সম্মান দিয়েছে।
তাঁদের হয়ে কিছু
বিদ্যাগত কাজও করেছি,
‘প্রমিত বাংলাভাষার
ব্যাকরণ’ সম্পাদনা
যেমন। সেটাও তাঁরা
জানেন। প্রয়াত কবি
শামসুল হক তো ওই বইয়ের
আমাদের দুই সম্পাদককে
তাঁর ‘দগ্ধ দেহে চাঁদের
নবনী’ কবিতার বইই
উৎসর্গ করেছিলেন। ভাবা
যায় !
আমাদের ভাষা এক,
সংস্কৃতি এক – অথচ
সাম্প্রদায়িক বিভেদের
কারণে আমরা ক্রমশ শত্রু
হয়ে যাচ্ছি। এ থেকে
উদ্ধারের পথ কি?
জাতপাতধর্ম—এই সব
কিছুকে অবান্তর করে
দেওয়াই পথ, কারণ এগুলি
প্রথমত অলীক বিশ্বাসের
ওপর, দ্বিতীয়ত
ধান্দাবাজদের
আধিপত্যের ইচ্ছা থেকে
স্থাপিত জিনিস।
ধান্দাবাজেরা মিথ্যা
বিশ্বাসকে সত্য বলে
চালিয়ে দেয় তাদের
আধিপত্য বজায় রাখার
জন্য। যদি আমরা ওগুলিকে
অস্বীকার করতে পারি
তাহলেই বাঙালি (এবং
মানুষ) পরস্পরের আরও
কাছে আসবে। মানুষকে
শুধু ‘মানুষ’ হিসেবে
দেখতে হবে। অনেক সময়
নরনারীর ভালোবাসা এই
দেখাতে সাহায্য করে,
তাই নানা সম্প্রদায়ে,
জাত ডিঙিয়ে, বিয়ে হয়।
ভালোবাসার এই দীক্ষাটা
যদি আমরা সকলে গ্রহণ
করি। শুধু নরনারীর নয়,
বন্ধুর ভালোবাসা,
সন্তানের দ্বিমুখী
ভালোবাসা, আরও ব্যাপক
মানুষের ভালোবাসা।
রবীন্দ্রনাথ এই
ভালোবাসার কথাই বলেন
‘পঞ্চভূত’-এ —‘একটি
ছেলে আসিয়া মাকে
পৃথিবীর সকল ছেলের মা
করিয়া দেয়।’
JNUতে বর্তমানে যা
চলছে সে সম্বন্ধে আপনার
মন্তব্য।
জেএনইউ, যাদবপুর,
প্রেসিডেন্সি আর
অন্যান্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের
(জামিয়া মিলিয়া, আলীগড়)
বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছেলেমেয়েরা সংগত কারণ
নিয়ে আন্দোলন করছে,
রাষ্ট্রশক্তি তাদের
ওপর পীড়ন নামিয়ে আনছে,
ভয় দেখানোর জন্যে।
ছেলেমেয়েরা ভয় পাবে বলে
মনে হয় না। তাদের ওপরেই
ভরসা।
আপনার লেখালেখি।
নিজের লেখা বই তো ৮৬-র
মতো হল, সম্পাদিত বই
৬০-এর বেশি। আরও লেখা
চলছে, প্রতিদিনই।
কিন্তু আর বায়ো-ডেটা
দিয়ে তোমাদের
ভারাক্রান্ত করব না।
অনেক কিছু পেয়েছি।
আপনার ইদানিংকার
যেকোনও একটা দিনের
রোজনামচা।
এখন আমার দৈনন্দিন
রুটিন হল—সকাল ছটায়
ওঠা, মুখ ধুয়ে নুন-গরম
জলে কুলকুচি করা, তার
পরে চার গ্লাস অল্প গরম
জল খাওয়া। তার পরে আধ
ঘণ্টা হন্ হন্ করে
ছাদে বা ঘরের মধ্যে
হাঁটা আর একটু ব্যায়াম।
তার পরে হারমোনিয়ামে
একটু গলা সেধে নিয়ে
পাঁচ-ছখানা
রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া।
তার পরে খানচারেক
(রোববারে সাতটা) খবরের
কাগজ পড়ে কম্পিউটারে
বসা। পড়াশোনা আর
লেখা—মূলত এই নিয়ে জীবন
কাটছে। আমি টেলিভিশন
দেখি না, খবরও না। তবে
রাত ন-টায় খেতে বসে দুটি
আধঘণ্টার সিরিয়াল দেখি,
যখন যেটা থাকে। এখন
চলছে ‘ফিরকি’ আর
‘গল্পগাথা
নকশিকাঁথা’। দশটায়
কম্পিউটারে ফিরি, একটু
মুখবই করি, রাত পৌনে
এগারোটা নাগাদ ঘুমোতে
যাই।
তবে নানা সামাজিক
কাজকর্ম—সভাসমিতিও
আছে। তার সংখ্যা কমিয়ে
আনছি ক্রমশ।
করোনা-ভাইরাস আরও কমিয়ে
দিচ্ছে, খুব মজায় আছি।
আর ‘নৈবেদ্যের ওপর কলা’
(এটা একজন ক্ষুব্ধ
মাঝারিদরের কবি আমার
সম্বন্ধে
বলেছিলেন—অনেক
সমিতিতে আমাকে রাখা হত
বলে), হওয়া অব্যাহত রাখা
যাচ্ছে না। মানুষের
ভালোবাসা আমার মধ্যে
বেঁচে থাকার ইচ্ছে
জুগিয়ে দেয়।
একটা জীবন মোটামুটি চলে
গেল। অপমান, আঘাত এসেছে,
কিন্তু আমাকে মাটিতে
শুইয়ে দিতে পারেনি।
বন্ধুরা ছিল, আমার
পরিবার ছিল, অন্যান্য
শুভানুধ্যায়ীরা
ছিলেন। অপ্রত্যাশিত
জায়গা থেকে সমর্থন আর
সহায়তা পেয়েছি। আমি মনে
করি, যা পেয়েছি সেটা
আদানি- আম্বানিদের
পর্যায়ের না হলেও আমার
পক্ষে প্রত্যাশার
অতীত। ছাত্রছাত্রী
থেকে শুরু করে,
পশ্চিমবাংলায়,
বাংলাদেশে এবং অন্যত্র
মানুষের ভালোবাসায় আমি
আপ্লুত।
ফেসবুক মন্তব্য