ধর্ম ও Religion

অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়



স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার সময় স্থির হয় যে ভারতীয় সরকার ও সংবিধান ‘secular’ হবে। ‘Secular’ কথার মানে, কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত না করা। সংবিধানের হিন্দি অনুবাদে লেখা হল *১. ভারতীয় সরকার ও সংবিধান ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ হবে । নিরপেক্ষ কথাটির আক্ষরিক অর্থ - অপেক্ষা না রাখা, অসম্পর্কিত, উদাসীন। ধর্ম-নিরপেক্ষ কথাটির অর্থ তাহলে দাঁড়ায় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না যে, ধর্মের সঙ্গে অসম্পর্কিত, উদাসীন। তার মানে তো অধার্মিক, ধর্মহীন। এ তো মারাত্মক ভুল! দেশ বা রাষ্ট্র ধর্মের অপেক্ষা না রাখলে চলবে কি করে? কেউ হত্যা করলে, চুরি করলে, ব্যাভিচার করলে, মিথ্যা বললে, নেশাভাঙ করে সমাজকে দূষিত করলে সে দণ্ড পাবে। এটাই তো ধর্ম। সেখানে ধর্ম-নিরপেক্ষ হলে কিসের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার করবে? সৎ পথে, ধর্ম মতে থেকে তবে তো রাষ্ট্র দেশ চালাবে। সুতরাং রাষ্ট্রকে ধর্ম-সাপেক্ষই হতে হবে, ধর্ম-নিরপেক্ষ হলে কখনোই চলবে না । তড়িঘড়ি বদলে লেখা হল ‘পন্থ নিরপেক্ষ’ (non-sectarian)। দুর্ভাগ্যবশত, ‘পন্থ নিরপেক্ষ’ খাতায় কলমেই থাকল, ‘secular’ বোঝাতে আজও ধর্ম-নিরপেক্ষ শব্দটিই প্রচলিত। শুধু তাই নয়, আজ ধর্ম আর religion সমার্থক হয়ে গেছে, religionএর অনুবাদ হিসেবে ধর্ম শব্দ স্কুল কলেজ আইন আদালত সর্বত্র স্বীকৃত। ভারতীয় সংবিধানে ধর্ম শব্দটি কি অর্থে ব্যবহৃত? ধর্ম আর religionএর প্রকৃত অর্থ কি? ধর্ম আর religion কি সত্যি এক? ধর্ম আর religion নিয়ে এইসব ধন্দ নিয়ে বর্তমান নিবন্ধটি।

সংস্কৃত ‘ধর্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ধৃ ধাতু (ধারণ) থেকে যার মানে, যা ধারণ করা হয়। সহজ করে বলতে গেলে ধর্ম মানে সনাতন (constant) স্বভাব, প্রকৃতি বা ধাতু (চলিতভাষায় যাকে বলা হয় ধাত)। প্রাণী-অপ্রাণী-জড়পদা ্থ সবার একটি সনাতন ধর্ম আছে। এই ধর্ম প্রকৃতির নিয়ম তাই এ সর্বজনীন, সর্বকালীন, সর্বদেশিক, কোনো অবস্থায় এর নড়চড় হয় না। আগুনের ধর্ম প্রজ্জ্বলন। সে নিজে প্রজ্জ্বলিত হয় এবং তার সংস্পর্শে যে আসে তাকে প্রজ্জ্বলিত করে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো যুগে আগুনের ধর্ম – প্রজ্জ্বলন। যদি দেখা যায় আগুন নিজে প্রজ্জ্বলিত নয় বা তার সংস্পর্শে যে আসে তাকে প্রজ্জ্বলিত করছে না, তবে চোখ বুজে বলা যেতে পারে যে তা আগুন নয়। আগুনের এই ধর্মের সঙ্গে religionএর কোনো সম্পর্ক নেই। হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান বা জৈন আগুন বলে কিছু হয় না। তেমনি হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান বা জৈন ভেদে আগুনের ধর্ম বদলে যায় না। মানুষেরও ধর্ম আছে। তা মনুষ্যধর্ম। এ-ও প্রকৃতির নিয়ম ও সনাতন হওয়া উচিত আর এর গুণও সর্বজনীন, সর্বকালীন, সর্বদেশিক, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো যুগে যে কোনো মানুষের জন্য সত্য হওয়া উচিত। কিন্তু মানুষের বেলায় ধর্মের সঙ্গে religion মিলে গিয়ে দেখা যায় হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, জৈন ইত্যাদি একাধিক ধর্ম এসে হাজির আর তাদের প্রকৃতি সনাতন নয়, একেক ক্ষেত্রে একেক রকম। এই ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

বেদ, উপনিষদ বা গীতায় ধর্মের কথা বলা হয়েছে কিন্তু কোথাও ‘হিন্দু ধর্ম’ বলে উল্লেখ নেই। এরকম কোনো ধারনাই সে যুগে ছিল না। সেটাই স্বাভাবিক। আমরা মানুষকে বলতে পারি না, সবাই আমার ধর্মে এসো। আমাদের গিয়ে মিলতে হবে মানুষের সনাতন ধর্মে। বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো। অবশ্য ধর্মকে সঙ্কুচিত ও বিকৃত করার চেষ্টা ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে। খৃষ্টপূর্ব আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে যখন গোটা ভারতবর্ষে ধর্মের সর্বজনীনতা ক্ষুণ্ণ, জাতপাতের বিভেদে সাধারণ মানুষ নিপীড়িত আর ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় তথা পুরোহিতরা নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করতে সচেষ্ট, সেই পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটে ভগবান *২ বুদ্ধের। তিনি ধর্মকে সঠিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত নেন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মানুষকে ধর্ম ধারণ করার বিদ্যা শিখিয়ে যান। ধর্মকে তাঁর মত সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সহকারে আর কেউ বোঝাতে পারেননি। তাই ধর্ম প্রসঙ্গে বারবার তাঁর ব্যাখ্যা উঠে আসতে বাধ্য। তিনি বলেন, ধর্ম প্রকৃতির নিয়ম, সেখানে বিভেদের স্থান নেই। যেকোনো সংগঠিত সম্প্রদায়ের বিপক্ষে ছিলেন তিনি কারণ ধর্মকে সঙ্কুচিত ক’রে যখনি কোনো সংগঠিত সম্প্রদায়ে বাঁধার চেষ্টা করা হয়, তখনি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হয় - হিন্দু-অহিন্দু, খৃস্টান-অখৃস্টান, মুসলমান-অমুসলমান, এমনকি বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ! এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ বুদ্ধ প্রবর্তন করেননি। যিনি সারা জীবন মানুষে মানুষে অন্বয়ের কথা বলেছেন, তিনি কী করে একটা সংগঠিত সম্প্রদায় পত্তন করতে চাইবেন যা মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায়?

ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ভগবান বুদ্ধ ৬টি গুণের *৩ উল্লেখ করেন। এই ছয়টি গুণের ওপর ধর্ম দাঁড়িয়ে থাকে, যেকোনও একটি ক্ষুণ্ণ হলে ধর্মের শুদ্ধতা নষ্ট হয়। ১) ধর্মের মধ্যে স্পষ্টতা থাকবে। অর্থাৎ ধর্ম পরিষ্কার ভাবে বলা থাকবে, তার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা, জটিলতা বা রহস্য থাকবে না। ২) ধর্মকে নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সম্যকভাবে জানা যাবে। অর্থাৎ ধর্ম শুধু অন্যের মুখে শুনে বা বই পড়ে জানার নয়, সম্যকভাবে জানার বস্তু। আগুন দগ্ধ করে সেটা লোকমুখে শুনে বা বই পড়ে জানা আর নিজের দগ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানায় তফাত আছে। দ্বিতীয়টা সম্যক জ্ঞান। ৩) ধর্মের ফল পরজন্মে নয়, এজন্মেই প্রত্যক্ষ করা যাবে। অর্থাৎ ইহজীবনের সুকর্ম বা দুষ্কর্মের ফল মৃত্যুর পরে না, এই জীবনেই হাতে হাতে ভোগ করবে। ৪) ধর্মের সংস্পর্শে যে আসবে সে তার অর্জিত পুণ্য সকলের সঙ্গে ভাগ করতে উদ্গ্রীব হবে। ধর্মের লক্ষণই হল, যে সুখশান্তি সে নিজে পেয়েছে, অন্যদেরও সেই সুখশান্তির আস্বাদ নিতে ডাকবে। ৫) ধর্ম সবার ক্ষেত্রে সমান এবং সর্বক্ষেত্রে কল্যাণকারী হবে। প্রকৃতির নিয়ম সবার জন্য এক – সূর্যের আলো দেবালয় আর ভাগাড়ে ভেদ করে না। প্রদীপের আগুন আর চিতার আগুনের প্রকৃতি আলাদা হয় না। ধর্মও তাই। একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হলে সেটা ধর্ম নয়। এছাড়া ধর্ম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কল্যাণকারী হবে। অকল্যাণের লেশমাত্র থাকলে তা ধর্ম নয়। ৬) ধর্ম প্রকৃত বোদ্ধার দ্বারা বোধগম্য হবে। প্রকৃত বোদ্ধা ধর্মকে সঠিক অর্থে বোঝেন তাই সাধারণ মানুষকে সঠিক পথে চালনা করতে পারেন। আগেকার দিনে ধর্মকথা বা ধর্মপাঠের আসরে কথক ব্রাহ্মণ বা ধর্মগুরু ধর্ম ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিতেন কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম। মনে রাখতে হবে, এখানে ধর্ম বলতে পুরনো দিনের অর্থে ধর্ম বোঝানো হয়েছে, আজকের অর্থে অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খৃস্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের পালনীয় রীতিনীতিকে বোঝানো হয়নি। মানুষকে ধর্ম ধারণে সহায়তা করাই ধর্মব্যাখ্যাতার কাজ। যিনি প্রকৃত বোদ্ধা নন, তিনি নিজে ধর্মকে ভুল বুঝবেন এবং বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে অপরকে ভুল দিশা দেবেন। তখন ধর্ম ব্যাখ্যা সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যা হয়ে উঠতে পারে।

মানুষ মূলত পশু, তাই পশুধর্ম তার স্বভাবের অঙ্গ। কিন্তু কিছু গুণ আছে যা দিয়ে মানুষকে পশুদের থেকে আলাদা করা যায়। তাকে মনুষ্যধর্ম বলে। ভগবান বুদ্ধ মনুষ্যধর্মের ৩টি লক্ষণ বা গুণ নির্দেশিত করেন। ১) নিজের এবং অপরের মঙ্গল হয় এমন কাজ করা ২) নিজের এবং অপরের অনিষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ৩) চিত্তকে নির্মল করা। *৪ পশু তার প্রবৃত্তির বশে ভালোবাসে বা আক্রমণ করে কিন্তু অপরের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় ভালোবাসা দিতে, অপরের অমঙ্গলাশঙ্কায় আঘাত প্রত্যাহার করতে বা দয়া, মায়া, ক্ষমা, করুণার অনুশীলন দ্বারা চিত্তকে নির্মল করতে সে পারে না। সেই ক্ষমতা একমাত্র মানুষের আছে। এই গুণগুলিকে ধারণ করাই মনুষ্যধর্ম আর যিনি মনুষ্যধর্ম ধারণ করেন, তিনি ধার্মিক।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ধর্ম যদি সর্বজনীন তবে সব মানুষের মধ্যে মনুষ্যধর্মের লক্ষণ দেখা যায় না কেন? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, জলের ধর্ম প্রবহমানতা। কিন্তু বদ্ধ জলাশয়ে জলের প্রবহমানতা দেখা যায় না। তার অর্থ এ নয় যে সেই জলের ধর্ম বদলে গেছে । বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেলে জল আবার আপন ধর্মে সবেগে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ জলের অভ্যন্তরে তার সনাতন ধর্ম চাপা থাকে । মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। বিকারের পুরু আবরণের নিচে সনাতন মনুষ্যধর্ম চাপা পড়ে থাকে। মন বিকারমুক্ত হলে মনুষ্যধর্মের রশ্মি চারদিকে বিচ্ছুরিত হয়। প্রসঙ্গত, বিশ্বে যাঁদের আমরা মহামানব, যুগাবতার, সন্ত, গুরু, মণীষী ইত্যাদি বলে মানি, পূজা করি, ভক্তি করি, মার্গপ্রদর্শক বলে মনে করি, দেখা যাবে তাঁদের সবার মধ্যে মনুষ্যধর্মের গুণগুলি বর্তমান - পুণ্যের পথে চলা, পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকা আর অপরের জন্য দয়া, মায়া, ক্ষমা, করুণায় হৃদয় বিগলিত হওয়া। ক্রুশবিদ্ধ যিশু নিদারুণ যন্ত্রণার মুহূর্তে তাঁর পীড়ণকারীদের সম্বন্ধে বলেন, ‘ঈশ্বর, এদের ক্ষমা করে দাও। এরা জানেনা এরা কী করছে’! শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর লাঞ্ছনাকারীদের বলেন, ‘মেরেছ কলসীর কানা তা বলে কি প্রেম দেব না?’ মোহম্মদের ওপর এক বুড়ির খুব রাগ, মোহম্মদ বুড়ির বাড়ির নিচে দিয়ে মসজিদে যান আর বুড়ি গালি দিতে দিতে রোজ মোহম্মদের মাথায় জঞ্জাল ছুঁড়ে ফেলে। মোহম্মদ নির্বিকার ভাবে নিজের পথে চলেন। একদিন বুড়ি গাল দেয় না, মাথায় জঞ্জাল পড়ে না। মোহম্মদ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বুড়ি ভালো আছে তো? ব্যাকুল মোহম্মদ বুড়ির খবর নিতে ছোটেন। কলকাতায় প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে শুনে বিচলিত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর সুদূর নির্জন তপস্যা ছেড়ে কলকাতায় ছুটে আসেন আর্তের সেবায নিজেকে উৎসর্গ করতে। একেবারে হাল আমলে, কোটি কোটি ডলারের সাম্রাজ্য-অধিপতি বিল গেটস সমগ্র বিশ্বের দীনদরিদ্র হতভাগ্যদের দুঃখ দূর করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এঁদের সবার religion হয়তো এক নয় কিন্তু ধর্ম এক। সে ধর্ম মনুষ্যধর্ম। আর এঁরা প্রত্যেকে যথার্থ অর্থে ধার্মিক।

এইবার আসা যাক religion এ। Religion শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘relegate’ থেকে, যার অর্থ to tie, to bind। Religion সমাজকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখে এই অর্থে শব্দটির উৎপত্তি। কেউ আবার বলেন religion এসেছে লাতিন "religo" থেকে যার অর্থ "good faith (পুণ্য বিশ্বাস)। বেঁধে রাখা বা পুণ্য বিশ্বাস যে অর্থেই হোক, দেখা গেছে religion সবসময় ঈশ্বর বা কোনও আরাধ্য জনের প্রতি ভক্তিকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। তবে আজকের দিনে ধর্ম আর religion সমার্থক হয়ে গেছে তাই ধর্মের বদলে religion বসিয়ে অনায়াসে বলতে পারা উচিত আগুনের religion প্রজ্জ্বলন, জলের religion প্রবহন, পাথরের religion কঠিনতা, পাখির religion ওড়া। কিন্তু পারা যায় না! তার কারণ ধর্ম আর religionএর অর্থ আদৌ এক নয়। ধর্মের অর্থ প্রকৃতি বা স্বভাব; religion এর অর্থ সম্প্রদায়, মানুষের মধ্যে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত গোষ্ঠী। মানুষের মধ্যে অনেক রকম গোষ্ঠী - একেক প্রদেশের মানুষ একেক গোষ্ঠী, লিঙ্গ, বর্ণ, পেশা ইত্যাদি ভেদে আলাদা আলাদা গোষ্ঠী, আবার কিছু মানুষ নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী আলাদা গোষ্ঠী বানিয়ে তাদের নিজস্ব কিছু নিয়মশৃঙ্খলা, রীতিনীতি স্থির করে সেইমত চলে। শেষোক্ত শ্রেণীর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় religion এর আওতায় পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন religion হয় তাই মানুষ religionএ এক হতে পারে না। কিন্তু সব মানুষের প্রকৃতি এক বলে তারা ধর্মে এক। যেমন, পাখি ওড়ে, সব পাখির মধ্যে এই সনাতন গুণ বর্তমান। অতএব বলা যায়, সব পাখির ধর্ম এক। কিন্তু পাখিদের মধ্যে যে নানান সম্প্রদায় - কাক, চড়াই, ময়ূর, বাজ ইত্যাদি, তারা উড়তে পারলেও যার যার সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন। একই ধর্মের ছাতার তলায় ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের পাখিরা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজ করে। তাই পাখি মৌল ধর্মে অভিন্ন কিন্তু সম্প্রদায়গত বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন। ধর্ম আর religionএর তফাতও ঠিক তাই। ধর্মে মানুষ অভিন্ন কিন্তু religion বা সম্প্রদায়গতভাবে ভিন্ন। এইজন্য ধর্মের প্রতিশব্দ religion হতে পারে না। ধর্মের প্রতিশব্দ হতে পারে Nature। তবে ধর্ম শব্দটির অর্থগত গভীরতা ও ব্যাপকতা মাথায় রেখে ইংরেজিতেও Dharma (ধর্ম) ব্যবহার করা সমীচীন।

মুশকিল হল, religion বহু কাল ধরে ধর্ম নামে পরিচিত হয়ে এসেছে। ফলে একদিকে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ-বিরোধ-রক ্তপাতের ভূমি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে ধর্ম শব্দের অর্থ পুরোপুরি ঘেঁটে গেছে! নিরপেক্ষভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে ধর্মের নামে যত বিরোধ সব আসলে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরোধ। ঈশ্বর সাকার না নিরাকার, এক, দুই না বহু, তিনি মন্দির, মসজিদ, গীর্জা না গুরুদ্বারে বিরাজ করেন এসব সম্প্রদায়ের কথা। কী খাওয়া উচিত, কী পরিধান করা উচিত, কাকে উপাস্য মেনে কোন পদ্ধতিতে আরাধনা করা উচিত, এসব বাইরের আচারবিচার ও বিধিনিষেধের কথা। কার বিধান শ্রেষ্ঠ, কার নীতিগ্রন্থ শ্রেষ্ঠ, কার উপাসনা-পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ – শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে এই দখলদারির লড়াইও স্পষ্টতই সম্প্রদায় সম্বন্ধীয়। ধর্মের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের একটাই উদ্দেশ্য, মনুষ্যধর্মের চর্চা অর্থাৎ ১) নিজের এবং অপরের মঙ্গল হয় এমন কাজ করা ২) নিজের এবং অপরের অনিষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ৩) চিত্তকে নির্মল করা। ব্যস, এই তিনটি গুণকে ধারণ করা ছাড়া বাকি সব গৌণ। কে কোন সম্প্রদায়ের কি বিধিনিয়ম পালন করল তাতে কিছু এসে যায় না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মনুষ্যত্ব গুণ ধারণের পথে একটা উপাচার খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা যেটা হিন্দু সম্প্রদায়ে উপবাস, জৈন সম্প্রদায়ে প্রর্যুষণ, মুসলমান সম্প্রদায়ে রোজা আর খৃস্টান সম্প্রদায়ে লেন্ট নামে প্রচলিত। একেক সম্প্রদায়ের উপবাসবিধি একেক রকম। এই বিধিনিয়মকে মানুষ যখন মুখ্য করে তোলে, তখনই ধর্ম হারিয়ে গিয়ে সম্প্রদায় বড় হয়ে ওঠে। আর সেখান থেকে শুরু হয় বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িকতা। এই সহজ কথাটা যখন অকারণে জটিল হয়ে ওঠে তখন তার পেছনে অজ্ঞানতা, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই ইত্যাদি অনেক কিছু থাকতে পারে কিন্তু মানুষের কল্যাণচেতনা কখনও নয়।

ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক ভারতীয়কে তার সম্প্রদায়গত রীতিনীতি পালনের স্বাধীনতা দেয়। তার মানে এ নয় যে সবার ধর্ম আলাদা হয়ে গেল। সবসময় মনে রাখতে হবে, মানুষের ধর্ম একটাই - মনুষ্যধর্ম। ‘ধর্মে সইবে না’, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’ বা ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ প্রবাদ-প্রবচনগুলিতে এই ধর্মের কথা বলা হয়েছে। মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠিরের অনুগামী সারমেয়বেশী ধর্ম, এই ধর্ম। যে ধর্মকে সংস্থাপনার্থে শ্রীকৃষ্ণ যুগে যুগে আবির্ভূত হওয়ার কথা বলেন তা হিন্দুধর্ম নয়, এই ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "মানুষের ধর্ম" গ্রন্থে হিন্দু ধর্ম বা ব্রাহ্ম ধর্ম নয়, এই ধর্মের কথা বলেছিলেন। আর ভগবান বুদ্ধের ধম্মং শরণম গচ্ছামির ধর্মও বৌদ্ধধর্ম নয়, এই ধর্ম – সনাতন মনুষ্যধর্ম।

জীবনে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে থাকে। সেই দুঃসময়ে যখন শোকে-তাপে-দুঃখে বুক বিদীর্ণ, কোথাও দিশা নেই, আলো নেই, হাত ধরে নিয়ে চলার সখা নেই, তখন ধর্ম পথ দেখায়। কিন্তু যে ধর্মতে নিজেকে বহু যতন করে ধুতে হয় মুছতে হয়, মলিন মর্মকে ঘষেমেজে নির্মল করতে হয়, সেই ধর্ম আজ বিস্মৃত। আজ ধর্ম মানে সম্প্রদায়, religion । তাই যে যার সম্প্রদায়ের দোরগোড়ায় বসে বাইরের দেবতাকে পুজো করে, ডুব ডুব ডুব ডুবসাগরে গিয়ে রত্নধন খোঁজার কাজ কেউ করে না। সময় এসেছে ধর্মকে সঠিক অর্থে চেনার, ধর্ম ও religion-এর তফাত বোঝার এবং ধর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করার। এ প্রসঙ্গেও ভগবান বুদ্ধের কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ধর্মের হাজার ব্যাখ্যা আর পথনির্দেশ অন্যেরা দিতে পারে। কিন্তু সেপথে চলতে হবে নিজেকেই। তাই ধর্মকে ধারণ করার দায়িত্ব যার যার নিজের। আত্তা হি আত্তানো নাথো। আত্তা হি আত্তানো গতি। *৫ তোমার কর্তা তুমি। তোমার ভবিষ্যৎ তোমার হাতে।।



*১) অনুবাদক তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত হিন্দি লেখক শেঠ গোবিন্দদাস

*২) ভগবান মানে এখনকার অর্থে ঈশ্বর নয়। পুরনোদিনের ভাষায় ভগবান শব্দের অর্থ ছিল, যাঁর রাগ, দ্বেষ ও মোহ ভঙ্গ হয়ে গেছে।

*৩) স্বাখ্খাতো ভগবতা ধম্মো সন্ধিত্থিকো অকালিকো এহি-পস্সিকো ওপনেয়য়িকো পচ্চত্তম

ভেদিতব্বো ভিন্নুহি তি।-ত্রিপিটক

*৪) সব্ব-পাপস্স অকরনম্, কুসলসস্স উপসম্পদা, স-চিত্ত পরিয়োদপনম্, এতম্

বুদ্ধানাসাসনম্। - ত্রিপিটক

*৫) - ত্রিপিটক


অলংকরণঃ অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

ফেসবুক মন্তব্য