১৫ই এপ্রিল ২০২০, বিকেল
ছয়তলার ব্যালকনি থেকে
একা একা শূন্যে হাত
নাড়ালে ব্যাপারটা কেমন
অদ্ভুত দেখায়, তাই না?
মনে হওয়ামাত্র হাত
নামিয়ে নিলাম। ঋজু কি
দেখতে পেল? জানি না। ওকে
নিয়ে
অ্যাম্বুল্যান্সের
মিলিয়ে যাওয়াটা শুধু
আমি দেখতে পেলাম।
মিলিয়ে যাওয়ার পরেও,
বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখতে
পেলাম।
এইসব দেখাশোনার ভেতর
হঠাৎ অনুপ্রবেশকারীর
মতো ঢুকে পড়ল আমার
বারান্দা বাগানের
গন্ধরাজ গাছটা। এবার
ফুল ফুটিয়েছে বেশ, সেই
জন্য হয়তো একটু বেশি
মনোযোগ দাবি করছে।
' এবার আমি কী করব বল
দেখি? ঋজু তো চলে গেল এক
মাসের কোয়ারেন্টাইন
ডিউটিতে। একা থাকতে
আমার যে খুব ভয় করে।'
কোনো উত্তর দিল না সে।
বিজ্ঞের মতো মাথা
দোলাতে লাগল শুধু।
দেখাদেখি অন্য
গাছগুলোও। এমনকি
আশেপাশের
বিল্ডিংগুলোও তালে
তালে মাথা দোলাতে শুরু
করেছে এবার। কেউ কোনো
কথা বলছে না, এভাবে সবাই
দুলছে, ওরা কি আমায় ভয়
দেখাচ্ছে?
আর এক মুহূর্তও
বারান্দায় না থেকে ঘরে
ঢুকে আমি টিভি চালিয়ে
দিলাম জোরে।
সংবাদপাঠিকা গম্ভীর
মুখে হিসাব দিচ্ছেন।
' ভারতে করোনা
আক্রান্তের সংখ্যা
১১৬৭৯, মৃত ৪৭০, সুস্থ
১২৩০।'
ক্রিকেটের স্কোর
শুনছি। কিংবা ভোটগণনা
চলছে পুরোদমে।
অহোরাত্র।
এবার অন্য চ্যানেল।
মহাভারত। কিছুক্ষণ
দেখার চেষ্টা করলাম।
সত্যি বলতে কী, মনে হল
কোনো সকরুণ যাত্রাপালা
দেখছি। উঠে পড়লাম। টিভি
চলতে লাগল। ঘরের মধ্যে
কারো থাকাটা খুব দরকার
আমার জন্য। সশরীরে না
হলেও, দরকার।
ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের
মতো শব্দটা মনে পড়ে
গেল। ' মনোফোবিয়া'। একটা
শর্টফিল্ম দেখেছিলাম
ইউটিউবে। একটি মেয়ে,
একা, পুরো বাড়িতে একদম
একা। প্রতি মুহূর্তে সে
অনুভব করে অন্য কারো
অদৃশ্য উপস্থিতি। রক্ত
হিম করা সে অনুভব, তারই
স্নায়ুর ভেতর থেকে জন্ম
নেওয়া দুঃসহ এক ভয়।
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে
ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল
যেন। ছুটে গিয়ে মূল
দরজার লক চেক করলাম।
ফ্ল্যাটের সমস্ত আলো
জ্বালিয়ে দিলাম। দরদর
করে ঘামতে ঘামতে সোফায়
বসামাত্র ফোন বেজে উঠল।
ঋজু। আমার চোখের জলে
ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল ওর
নাম।
২৫ এপ্রিল ২০২০, ভোর
ভোরবেলার বারান্দা
তেমন দুর্বোধ্য লাগে না
আজকাল। বরং একটু বেশি
কাছের মনে হয়। রিনরিনে
হাওয়া দেয়, দু- একটা
টিয়াপাখি দোলে
ইলেকট্রিক তারে। আরো কত
নাম না জানা পাখির ডাক
শুনি। গাছে জল দিতে
দিতে প্রাণভ'রে শ্বাস
নিই। সূর্য ডুবলেই
ছবিটা পুরো বদলে যায়।
মৃত্যু। কিংবা মৃত্যুর
চেয়েও গাঢ় গভীর অন্ধকার
নেমে আসে চারদিকে।
আপাত- নিরীহ
বিল্ডিংগুলো দৈত্যের
মতো গিলে খেতে আসে
আমায়। গত দশদিনে একটিও
মানুষের মুখ দেখিনি।
এই হাউজিং কমপ্লেক্সটা
নতুন। মাত্র দুই মাস হল
এসেছি। খুব বেশি লোকজন
নেই এখনও। আমাদের
ব্লকেই রয়েছে মাত্র
আটটি পরিবার। ছয়তলার
গোটা ফ্লোরে আমি একা।
খাঁ খাঁ করে। কখনও
দাপিয়ে বেড়ায়।
শূন্যতা। ঘুমোতে পারি
না। দুশ্চিন্তা, অবসাদ,
ভয়, আতঙ্ক, একাকীত্ব।
এমন সশস্ত্র সৈন্যদলের
মুখে কোণঠাসা আমি।
অসহায় বোধ করি। মাথার
পাশে আমজাদ আলি খান
সরোদ বাজান। অভয় দেন।
সারারাত। আমার খুব
মায়ের কথা মনে পড়ে।
চা খেতে খেতে মনস্থির
করে নিলাম। ঋজুর ফোন
এলে কথা সেরে নিয়েই বের
হব আজ। কিছু কেনাকাটা
করব প্রয়োজনীয়।
বদ্ধঘরে আমি আর পারছি
না থাকতে। ঋজু
সারাদিনে দু- বার ফোন
করে। অপেক্ষা ছাড়া আর
কিছু করার উপায় নেই
আমার। অপেক্ষা করতে
করতে আমি রান্না করি,
বাসন মাজি, ঘর মুছি।
অপেক্ষা করতে করতে টিভি
দেখি, বই পড়ি, ফেসবুক
করি। আর হাত ধুই। হাত
ধোয়ার মতো
গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই
মুহূর্তে যেন আর কিছুই
নেই। স্যানিটাইজারের
গন্ধ পারফিউমের চেয়েও
বেশি প্রিয় এখন। হঠাৎ
করে জীবনটা পুরো বদলে
গেল কেমন। নতুন
ফ্ল্যাটে আসা নিয়ে আমার
আর ঋজুর কী উত্তেজনাই
না ছিল! নিজেদের মতো
স্বাধীন জীবন কাটাবো
সেই আনন্দে মশগুল। কত
কী পরিকল্পনায় বুঁদ হয়ে
থাকতাম দুজনে। ইদানীং
চুম্বকের মতো টানছে
পুরনো একটা বাড়ি।
একান্নবর্তী সংসার।
ঘষাকাচের ওপারে
দাঁড়ানো কিছু মানুষ। এক
এক করে তারা নিঃশব্দে
আমার হাতের পাতায় জড়ো
হতে থাকে। আমিও ঘষে ঘষে
ধুয়ে ফেলতে থাকি আমার
যাবতীয় অপরাধবোধ।
২৫ এপ্রিল ২০২০, সকাল
কম্পলেক্সের বাইরে পা
রাখতে যেতেই সিকিউরিটি
গার্ড বাধা দিলেন। অবাক
হয়ে তাকিয়ে রইলাম
ভদ্রলোকের মুখের দিকে।
পুরো মুখ দেখা গেল না
যদিও। মুখোশে ঢাকা। তবু
মানুষ তো। কতদিন পর
মানুষ দেখলাম! উনি আমায়
অনুরোধ করলেন বাইরে না
যাওয়ার জন্য। কিছু
দরকার হলে ওরা আনিয়ে
দেবেন। সেই ব্যবস্থা
করা হয়েছে। শুধু ফোন
করে দিলেই হবে। একটি
ফর্ম দিলেন। কিছু
ব্যক্তিগত তথ্য আর
সুবিধা- অসুবিধা জানিয়ে
ভর্তি করতে হবে। করলাম
অগত্যা। তারপর
কম্পলেক্সের ভেতরেই
ঘুরে বেড়াতে লাগলাম
উদ্দেশ্যহীনভাবে।
যতক্ষণ না কেউ বাধা
দেয়।
বিল্ডিংগুলো
স্যানিটাইজ করা হচ্ছে,
একটা অস্বস্তিকর
যান্ত্রিক ঘরঘর শব্দে
চারপাশের নিস্তব্ধতা
ভেঙে খান খান। নির্জলা
সুইমিং পুলটা
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
রয়েছে আকাশের দিকে। মনে
হয় বৃষ্টি চাইছে খুব।
কমিউনিটি হল,
চিলড্রেন্স পার্ক,
জিমনাসিয়াম বন্ধ।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা
ভেতরে চলে এসেছি।
এদিকটায় গাছগাছালি
বেশি। ছোট্ট জলাশয়।
দুটো হাঁস আপনমনে ভেসে
বেড়াচ্ছে। একটু দূরে
জারুল গাছের নিচে কাঠের
বেঞ্চ পাতা। একটি মেয়ে
চুপচাপ বসে আছে। দু পা
এগিয়ে যেতেই মুখ তুলে
চাইল। তীব্র ব্যথার
ভাঙচুর সেই মুখে, চোখ
ভরা জল! আমি আর এগোতে
সাহস পেলাম না।
তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে
হাঁটতে শুরু করলাম
নিজের বিল্ডিং এর দিকে।
একটিবার মাত্র পিছন
ফিরে দেখেছিলাম
কৌতুহলে। সে তখনও
একইভাবে অপলক চেয়ে ছিল
আমার ফিরে আসার দিকে।
কী যে ছিল সেই চাহনিতে,
আমি বলে বোঝাতে পারব
না।
২রা মে ২০২০, সন্ধ্যা
একা থাকাটা ক্রমশ এই
অতিমারীর চেয়েও
ভয়ংকরভাবে অসহনীয় হয়ে
উঠছে। মানসিকভাবে
অসুস্থ হয়ে পড়ছি, বুঝতে
পারছি। মনোবিদ বন্ধুর
কথামতো ধ্যান করি রোজ।
মনঃসংযোগ সহজ নয়, তবু
চেষ্টা করি।
আক্রান্তের
উর্ধ্বমুখী গ্রাফ, ঋজুর
জন্য উদ্বেগ, মানুষের
সীমাহীন দুর্দশা
আপাত-নিরাপদ আমাকে
অস্থির করে তোলে, তবু
সেসব চিন্তা প্রাণপণে
সরিয়ে আমি আবার ব্যস্ত
হয়ে পড়ি ফেসবুকে। কতরকম
চ্যালেঞ্জ! সমস্ত
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে
করতেই আমি লাইভ ভিডিও
করি। কেন্দ্র ও রাজ্য
সরকারের অপদার্থতা
নিয়ে কথা বলি,
মাঝেমধ্যে গান গাই,
কবিতাও পড়ি। তারপরেও
অবসাদ এলে চোখ বন্ধ করে
মেয়েটির দুই চোখ ভাবি।
গভীর যন্ত্রণার
প্রতিচ্ছবি সেই দুটি
চোখ! আমায় দু দন্ড
শান্তি দেয়। কারো
কষ্টের বিনিময়ে সুখ
খুঁজে নেওয়াটাও এক
ধরনের আত্মরতি। আমি
আজকাল সেই আত্মরতিতে
বিভোর হয়ে থাকি।
৫ই মে ২০২০, দুপুর
ঠিক দুপুরের খাওয়ার পর
ফোনটা এল। অচেনা নম্বর।
ইদানীং ঋজু ছাড়া কারো
ফোন এলে ধরি না। সমস্ত
সোশ্যাল মিডিয়াও বন্ধ
করে দিয়েছি। এই ফোনটাও
ধরলাম না। তিনবার বেজে
বেজে বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে একটা
মেসেজ ঢুকল।
' ফোনটা ধরুন অনুগ্রহ
করে। আমি নিলয় দাস। এই
আবাসনেরই বাসিন্দা। '
ঠিক দশ মিনিট পর আবার
ফোন। ইচ্ছা করছে না, তাও
রিসিভ করলাম।
- হ্যালো। বলুন।
ওপারে মার্জিত
পুরুষকন্ঠ।
- নমস্কার। আমি নিলয়।
আপনার উল্টোদিকের
বিল্ডিং- এ থাকি। ফোর্থ
ফ্লোর।
- আচ্ছা।
- আপনি মনে হয় এবারের
মিটিং- এ ছিলেন না।
আপাতত এই আবাসনের সকলের
সুবিধা- অসুবিধার
প্রাথমিক খোঁজ খবর
নেওয়ার দায়িত্ব আমাকে
দেওয়া হয়েছে।
ফর্মগুলিও আমার কাছেই
জমা পড়েছে। সেখান থেকে
আপনার নম্বর পেলাম।
- আসলে আমার
হাজব্যান্ডই
মিটিংগুলো অ্যাটেন্ড
করে। ওহ তো এখন নেই। আমি
এ বিষয়ে কিছু জানতাম
না।
- জানি। ওঁকে তো এই
পরিস্থিতিতে
হাসপাতালেই থাকতে
হচ্ছে।
- হ্যাঁ।
- একা রয়েছেন। কিছু
প্রয়োজন হলে জানাবেন
অবশ্যই।
- নিশ্চয়ই। ধন্যবাদ।
কিছুক্ষণ নীরবতা। দু
তরফেই।
আবারও ভেসে এল
পুরুষকন্ঠ।
- তবে আজ এক বিশেষ কারণে
ফোন করলাম আপনাকে। একটি
অনুরোধ করব ম্যাডাম।
- বলুন।
-ঠিক বিকেল চারটেয়,
একবার ব্যালকনিতে
আসবেন? কেন বলছি, সেটা
তখনই না হয় জানতে
পারবেন। কিন্তু আসবেন
প্লিজ।
এ আবার কেমন আবদার!
বিরক্তই লাগল একটু।
কিন্তু মুখে বললাম,
- বেশ, থাকব।
ফোন কেটে গেল।
ততক্ষণে ঠিক করে
নিয়েছি। যাব না। অচেনা-
অজানা কে এক নিলয় দাস।
সে বললেই আমায়
ব্যালকনিতে যেতে হবে?
পরে জিজ্ঞাসা করলে বলে
দেব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ব্যস।
সত্যি সত্যিই
তন্দ্রামতো এসে গেছিল
আমার। ঘুম ভাঙল কলিং-
বেলের শব্দে। এইসময়? কে
এল?
আই- হোলে চোখ রেখে
দেখলাম কেয়ারটেকার।
দরজা খুলতেই দূরত্ব
বজায় রেখে সে আমার হাতে
একটি প্যাকেট ধরিয়ে
দিল।
- কী এটা?
- জানি না ম্যাডাম। দু
নম্বর ব্লক থেকে
পাঠিয়েছে।
বলে সে চলে গেল।
দু নম্বর ব্লক? মানে
উল্টোদিকের বিল্ডিং?
আমার দুপুরের ফোনের কথা
মনে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ
ঘড়ির দিকে দেখলাম।
চারটে বাজতে দশ।
কী যে হচ্ছে কিছুই
বুঝতে পারছি না।
দুপুরের ওই ফোন। তারপর
এই প্যাকেট৷ একটু ভয় ভয়
করতে লাগল। প্যাকেট
খোলা কি উচিত হবে? যাক
গে, দেখিই না খুলে।
কয়েক মুহূর্ত পরের
অনুভুতি , এ যাবৎকালের
চেনা কোনো শব্দে আমি
প্রকাশ করতে পারব না।
একটি ঘরে তৈরি কেক।
অনাড়ম্বর। ওপরে যত্ন
করে লেখা।
' শুভ জন্মদিন মালিনী'!
আমার বত্রিশ বছরের
জীবনে খুব বেশি বিস্মিত
আমি হইনি। চরম
বাস্তববাদী বলেই হয়তো।
মনে আছে, ঋজু যখন আচমকা
বিয়ের প্রস্তাব
দিয়েছিল, তখনও অবাক
হওয়ার চেয়ে খুশিই
হয়েছিলাম বেশি। যেন
এমনটাই হওয়ার ছিল।
কিন্তু আজ, এই চরম
দুর্দিনে..
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম
আজ পাঁচই মে। আমার
জন্মদিন! ঋজুও ভুলে গেল!
অবশ্য ওকে দোষও দেওয়া
যায় না। যে অমানুষিক
ধকল ওর ওপর দিয়ে
যাচ্ছে। শুধু মায়ের
জন্য বুকটা মুচড়ে উঠল
একবার। আজ যদি মা বেঁচে
থাকত....
৫ই মে ২০২০, বিকেল
ঘড়িতে এখন চারটে বেজে
পাঁচ। কেক হাতে নিয়ে
ব্যালকনিতে এসে
দাঁড়ালাম। গত পনেরো দিন
হা- পিত্যেশ করেও যা
দেখতে পাইনি। যতদূর চোখ
যায়, প্রতিটি
বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে
নিচে, ব্যালকনিগুলোতে
শুধু মানুষ আর মানুষ! ওই
তো, মুখোমুখি
বিল্ডিংয়ের পাঁচতলার
ব্যালকনি থেকে হাত
নাড়ছেন একজন। উনিই
বোধহয় নিলয়। জোরে বলে
উঠলেন,
- শুভ জন্মদিন ম্যাডাম।
কেকটা কাটুন।
সমস্বরে আরো কয়েকজন।
চারদিক থেকে ধ্বনিত হতে
লাগল, ' শুভ জন্মদিন, শুভ
জন্মদিন, শুভ
জন্মদিন.........
ঠিক নিচের ফ্লোরের
ব্যালকনি থেকে ছোট্ট
ছেলেটি হাততালি দিয়ে
গেয়ে উঠল,
' হ্যাপি বার্থডে টু
ইউ.....'
চারপাশ থেকে অজস্র
হাততালির শব্দ,
গোধূলিবেলা, উড়ন্ত
পাখপাখালির
ঝাঁক...রীতিমতো গায়ে
কাঁটা দিচ্ছে! এমন
স্বপ্নের মতো জন্মদিন
অপেক্ষা করছিল আমার
জন্য!
নিজের অজান্তেই বুঝি।
আমিও গেয়ে উঠলাম
হাততালি দিয়ে,
' উই শ্যাল ওভারকাম, সাম
ডে...'
আবারও ঢেউ উঠল ব্যালকনি
থেকে ব্যালকনিতে।
মৃত্যুর গন্ধ ছাপিয়ে,
চরাচরব্যাপী
নৈঃশব্দ্য ভেঙে
গুঁড়িয়ে দিয়ে, গলা তুলল
আশাবাদ। হাতে তার
অদৃশ্য বিজয়পতাকা।
এমন অলৌকিক বিকেলের
প্রতি কৃতজ্ঞ আমি,
যতদূর পারি, মুখ বাড়িয়ে
সকলকে ধন্যবাদ জানাতে
লাগলাম।
হঠাৎ একটি দৃশ্য আমায়
চমকে দিল। এই ছয়তলার
ব্যালকনি থেকেও স্পষ্ট
দেখতে পেলাম। শুনতেও
পেলাম।
আবাসনের ভেতরের ফাঁকা
রাস্তা ধরে বেহালা
বাজাতে বাজাতে হেঁটে
যাচ্ছে সেই মেয়েটি!
আশেপাশের কোলাহলে ডুবে
যেতে যেতেও সন্ধ্যার
বাতাসে কাপাস তুলোর মতো
ভেসে বেড়াচ্ছে সেই সুর।
' দ্য সোয়ান'। মৃদু অথচ
অমোঘ! একবার থমকালো।
মুখ তুলে চাইল আমার
দিকে। মনে হল হাসছে।
আলতো হাত নাড়ার ভঙ্গি।
তারপর আবার হেঁটে চলে
গেল ওই জলাশয়ের দিকে।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
- এই শোনো। চলে যেও না।
সে ফিরে তাকালো না।
আবারও ডাকলাম। কী
আশ্চর্য! এত মানুষ। কেউ
ওকে দেখতে পাচ্ছে না?
১২ই মে ২০২০, সকাল
সেদিনের পর থেকে নিজেকে
একটিবারের জন্যও একলা
মনে হয়নি। প্রায় রোজই
আমরা ব্যালকনিতে
দাঁড়াই। গান গাই, গল্প
করি। একে অপরকে আশ্বাস
দিই। বিশ্বাস করি, এই
অসম যুদ্ধ আমরা জিতবই।
আর হ্যাঁ, প্রতিদিন সেই
বেঞ্চটার কাছে যাই।
মেয়েটিকে দেখতে পাইনি
আর কখনও। জানি পাব না।
শুধু বেঞ্চের ওপর একটি
করে ফুল রেখে আসি। আমার
বারান্দা-বাগানের
গন্ধরাজ ফুল।
অলংকরণঃ কল্লোল রায়
ফেসবুক মন্তব্য