অ্যাম্বুলেন্স আসছে

অনিরুদ্ধ দত্ত



গতকাল থেকেই খুশখুশে কাশিটা শুরু হয়েছিল। সেই সাথে গলা ব্যথা। ঢোঁক গিলতে গেলে লাগছে। অনুর মনটা কু ডাকল। এই সংক্রমণের বাজারে এমন কাশি তো ভাল কথা নয়। পর মুহূর্তেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। কী করে হবে? লকডাউনের আগে থেকেই অনু বাড়ির মধ্যে, সেই যেদিন জনতা কার্ফু হল সে দিন থেকেই। দুজন কাজের লোক, দুজনই তো সে দিন থেকে হাওয়া। দুটো লোকের কাজ, অনু একা হিমশিম খাচ্ছে! বাড়ির বাইরে পা রাখার সুযোগ কোথায়? ভাইরাসের সাথে দেখা হবার তো কোন চান্সই নেই। অনু আপনমনে মুচকি হাসে। এক যদি শেখর সাথে করে নিয়ে এসে থাকে। কিন্তু সে তো দিব্যি ফিট। হাঁচি কাশির চিহ্ন মাত্র নেই। তা ছাড়া, করোনা প্রতিরোধের ব্যাপারে শেখর দারুণ সিরিয়াস, নিজে সব কিছু মেনে চলছে, অনুকেও মানতে বাধ্য করছে। আজগুবি চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে অনু কিচেনে ঢুকল।

শেখরটা সকাল থেকেই ব্যস্ত। ল্যাপটপ খুলে বসে গেছে। সফ্টওয়্যার ইন্জিনীয়ার, ওদের বাড়িও যা অফিসও তা। কোলের ওপর ল্যাপটপটা রাখল কি কাজ শুরু। আর বাড়ি থেকে কাজ করার সুয়োগ পেয়ে ডবল উৎসাহে কাজ করছে। ওদের বিয়ের পাঁচ বছর হল। প্ল্যান অনুযায়ী এত দিনে প্রথম বাচ্চাটা এসে যাবার কথা। কিন্তু ওরা বাধ্য হয়েছে প্ল্যানটা চেঞ্জ করতে। গত দেড় বছর ধরে শেখরের একটা পোস্টিং হবার কথা চলছে - ওদের সিয়াটেল অফিসে। একে আমেরিকা, তার ওপর ওটাই ওদের হেড অফিস, উন্নতির সুযোগ অনেক বেশি। সেই দিকেই ওরা দুজন তীর্থের কাকের মত চেয়ে আছে। এই হল এই হল করে দেড় বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু হচ্ছে কই? বাচ্চাটা আমেরিকার মাটিতে জন্মাক এটা ওরা দুজনেই চায়। নন-স্টিকি কুকওয়ারে প্লাস্টিকের খুন্তি নাড়তে নাড়তে অনু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সারাটা দিন ঘরের কাজে কম্মে পার হয়ে গেল বটে, কিন্তু কাশিটা থেকে থেকেই জানান দিচ্ছিল - সে আছে। এবং তার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুপুরে ঘুমানোর বদ অভ্যাস অনুর কোনদিন ছিল না। কিন্তু এই লকডাউনের কল্যাণে সেটাও হয়ে যাচ্ছে। আর ঘুমেরই বা কী দোষ? সংসারের কাঁড়ি কাঁড়ি কাজ সব তো ওকেই করতে হচ্ছে। শরীরটা বিছানায় পড়ছে আর সোজা ঘুমের দেশে।

ঘুমের মধ্যেই অনু টের পেল - জ্বর আসছে। ঘুম ভাঙল মাথার যন্ত্রণায়। জানালা দিয়ে দেখল বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে গেছে। না, জ্বরের ওষুধ খেতেই হবে। অবসন্ন শরীরটা নিয়ে বিছানা থেকে নামল অনু। পা ঘসটে ঘসটে বসার ঘরে এসে দেখল শেখর সোফায় বসা। পা দুটো সেন্টার টেবিলের ওপর তোলা। পাশে দুটো মোবাইল, কোলের ওপর ল্যাপটপে দুহাতের আঙুল চলছে। অনুর পায়ের শব্দে চোখটা এক মুহূর্তের জন্য উঠল।
- ঘুম ভাঙল?
- দেখ তো আমার কি জ্বর এসেছে?
শেখর আলতো করে অনুর কপালে আঙুল ছোঁয়ায়। পরক্ষণে চমকে ওঠে।
- এ তো ধুম জ্বর! কখন হল?
- জ্বর, কাশি, গলা ব্যাথা - আমার করোনা হল নাকি গো?
- যা:, কি যে বল তুমি! সাত দিন ঘরবন্দী হয়ে আছি, আমাদের করোনা হবে কোত্থেকে?
- না হলেই বাঁচি।
- ওষুধ খেয়েছ?
- না, চা খেয়ে খাব।
- তুমি বোস এখানে। আমি চা করছি।
অনু সোফায় বসে। শেখর উঠে যায়। যেতে যেতে বলে, দাদাকে ফোন করে বলি?
- আরেকটু দেখি না। এই তো সবে জ্বর এল।
শেখরের দাদা ডাক্তার। নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে এ্যাটাচড।

শেষ পর্যন্ত ফোনটা করতেই হল। অনুর শ্বাসকষ্ট শুরু হল। রাত বাড়ার সাথে সাথে কষ্টও বাড়তে থাকল। নিরুপায় হয়ে শেখর দাদাকে ফোন করল। রাত তখন সাড়ে এগারোটা।
- সিম্পটম তো ভাল নয়। আরো আগে জানাসনি কেন?
- আজই তো হল।
শেখর অপরাধীর মত বলে।
- আজকের রাতটা বাড়িতেই রাখ। প্যারাসিটামল কন্টিনিউ কর। কাল সকালে আমার হসপিটালে ট্রান্সফার করে নেব। আমি আইসোলেশন ওয়ার্ডে বলে রাখছি। এখন নিয়ে গিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই এখন স্টাফ কম। রাতে তো আরো কাউকে পাবো না। কাল সকাল ন’টা নাগাদ অ্যাম্বুলেন্স যাবে। রেডি থাকিস। আমি হসপিটালেই তোদের মীট করব। অনুকে বলিস ভয়ের কিছু নেই। ছাড়ছি।

দাদার ফোনটা ছেড়ে শেখর শোবার ঘরে যায়। দেখে, ঘরের আলো জেলেই অনু ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। গলা দিয়ে কেমন একটা ঘরঘর আওয়াজ হচ্ছে। সারা মুখে একটা কষ্টের ছাপ। শেখরের খুব মায়া হয়। আলো নিভিয়ে ওর মাথার কাছে বসে।


কাল রাতে কারুরই ঘুম হয়নি। রাত দুটো নাগাদ অনুর শ্বাসকষ্টটা বাড়ল। সোজা হয়ে শুতে পারছিল না। শেখর ওর পিঠের পেছনে বালিশের সাপোর্ট দিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিল। একটু আরাম পেল অনু। কিন্তু, গায়ের জ্বরটা ছাড়ছেই না। সাথে দমকা কাশি। শেখর আবার প্যারাসিটামল দিল। অনুর পাশে বসে ওর হাতটা মুঠো করে ধরল। অনু ওর কাঁধে মাথা রাখল। শেখর অনুর মাথায় হাত বোলাতে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আকাশে তখন ঊষার প্রথম আলো।

সকাল ছ’টা বাজলে শেখর চা করল। নিজে খেল, অনুকে দিল। চা টা খেয়ে অনু যেন একটু আরাম পেল। শেখর ওকে ধরে এনে বসার ঘরের সোফায় বসাল। ওর কথা মত ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে দিল। তারপর থেকে শুধু অপেক্ষা কখন অ্যাম্বুলেন্স আসে। দাদা ফোন করে অনুর খোঁজ নিলেন। সকাল আটটার সময় হসপিটাল থেকে ফোন এল। অ্যাম্বুলেন্স নটার মধ্যে পৌঁছে যাবে। শেখর নিশ্চিন্ত হল। সত্যি, অনুর কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না। যত তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া যায়।

দশ মিনিটের মধ্যে দরজায় বেল বাজল। শেখর ভুরু কুঁচকে তাকাল। এত তাড়াতাড়ি তো অ্যাম্বুলেন্স আসবে না। এই সময় কে এল? এই লকডাউনের মধ্যে বাইরের কাউকে দরজা খুলতে চায় না শেখর। গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল - কে?
- স্যার আমি বিজয়, সিকিউরিটির লোক।
- অ্যাম্বুলেন্স এসেছে?
শেখর জানতে চায়।
- না স্যার, পুলিশ এসেছে।
শেখর আর অনু পরস্পরের দিকে তাকায়। দুজনের চোখে প্রশ্ন।
শেখর গলা তুলে বলে -
- কাকে খুঁজছে?
- স্যার আপনাকে। বলছে - শেখর চ্যাটার্জি।
শেখরের ভুরুটা আরো কুঁচকে যায়। অনু ওর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে।
শেখর অনিচ্ছুক হাতে দরজা খোলে। সাদা ইউনিফর্ম, কোমরে বেল্ট, মাথায় টুপি, হাতে একটা ডায়েরী। সেই সাথে নাক মুখ ঢাকা মাস্ক।
- লোকাল থানা থেকে আসছি। সাব ইন্সপেক্টর প্রদীপ দেবনাথ। এখানে শেখর চ্যাটার্জি কে আছেন?
দরজার বাইরে থেকেই পুলিশের লোকটা কথা বলে। ভেতরে আসে না।
- হ্যাঁ, আমি শেখর চ্যাটার্জি। বলুন।
- বলছি।
ডান হাত দিয়ে টেনে আস্তে করে মাস্কটা নামিয়ে দেয়। চোখের ইশারায় সিকিউরিটির লোকটাকে চলে যেতে বলে। বিজয় চলে যায়।
- আপনি পেন আং নামে কোন মেয়েকে চেনেন?
শেখর বিরক্ত হয়।
- না, চিনি না। এরকম নাম জীবনে শুনি নি। দেখুন, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। হসপিটালাইজড হবে, অ্যাম্বুলেন্স আসছে।
- ওহ্!
ইন্সপেক্টর একটা বিদ্রুপের হাসি হাসে। আবার পুরোন প্রসঙ্গে ফিরে আসে।
- তাহলে আপনি চেনেন না?
- বললাম তো চিনি না।
শেখরের কথায় বিরক্তি ঝরে পড়ে। অনু আলতো করে ওর হাত স্পর্শ করে। শান্ত হতে ইশারা করে।
- আমি একটু ধরিয়ে দিই?
ইন্সপেক্টর বলে।
- পেন আং থাইল্যান্ডের মেয়ে। টুরিস্ট ভিসা নিয়ে মাস খানেক আগে ইন্ডিয়ায় আসে। এখানে 'হেভেনলি স্পা' নামে এক মাসাজ পার্লারে কাজ শুরু করে। পাঁচ ছ’ দিন আগে জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। গতকাল তার রিপোর্ট এসেছে - করোনা পজিটিভ। তারপর ঐ স্পা খুলিয়ে ওদের রেজিস্টার খাতা দেখে যার যার সাথে মেয়েটি বডি-কন্ট্যাক্টে এসেছে, তাদের আমরা ট্রেস করছি। ঐ খাতা থেকে আমরা আপনার নাম ফোন নাম্বার পেয়েছি।
- কী বাজে বকছেন! গত সাত দিন ধরে আমি বাড়ি-বন্দী। লকডাউনের প্রথম দিন থেকে...
- এটা লকডাউনের আগের গল্প স্যার! লকডাউনের তিন দিন আগে। ২০শে মার্চ শুক্রবার। লকডাউনের মধ্যে আর যাবেন কি করে? পার্লার তো আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওদের খাতায় আপনার যে নাম্বারটা পেয়েছি, একবার মিলিয়ে নিই।
ইন্সপেক্টর হাতের ডায়েরীটা খুলে পড়তে থাকে -
- নাইন এইট...
গড় গড় করে শেখরের মোবাইল নম্বরটা নির্ভুল পড়ে দেয়।
শেখর আড় চোখে অনুর দিকে তাকায়। অনু চোখ সরিয়ে নেয়। পরক্ষণেই অনুর কাশি শুরু হয়। শেখর ওকে ধরতে যায়। অনু ঠেলে সরিয়ে দেয় ওর হাত। পুলিশের লোকটা আরেকবার বিদ্রুপের হাসি হাসে। কেটে কেটে বলে,
- অসুখটাতো মেয়েটার কাছ থেকে হাতে করে এনে ম্যাডামকে গিফ্ট করেছেন মনে হচ্ছে। এদিকে নিজের তো তেমন কোন লক্ষণ নেই। ক্যারিয়ার অথচ নো সিম্পটম! স্বাস্থ্য ভবনে জানাতে হবে। যাই হোক, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন ম্যাডামকে হাসপাতালে পাঠান। আপনি আবার সঙ্গে যাবেন না যেন। স্বাস্থ্য ভবন থেকে আপনার প্রতি কড়া নির্দেশ আছে আপনি চোদ্দ দিন বাড়ির বাইরে পা রাখবেন না। দোকান বাজার কিচ্ছু না। ডিপার্টমেন্ট থেকে রোজ ফোন করে আপনার খোঁজ নেবে। থানা থেকেও লোক এসে দেখে যাবে। আর এর মধ্যে সিম্পটম দেখা দিলে ওনাদের জানাবেন। ওকে? আমি চলি। আমাদের থানার নম্বর আপনার কাছে আছে তো?
শেখর যন্ত্রের মত মাথা নাড়ে।
- কোন হেল্প লাগলে জানাবেন। চলি। চলি ম্যাডাম, গেট ওয়েল সুন। চিন্তা করবেন না। আপনি ভাল হয়ে যাবেন।


পুলিশের লোকটা চলে যায়। শেখর দরজা বন্ধ করে। অপরাধীর মত ঘরের ভেতরে আসে। দূরের একটা সোফায় বসে। অনুর দিকে আড় চোখে দেখে। অনু চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলে না। বাইরেটা নিস্তব্ধ, ঘরটাও নিস্তব্ধ। প্রায় আধঘন্টা পার হয়ে যায়। শেষে অনু স্তব্ধতা ভাঙে।

- করোনা পেশেন্ট যারা হসপিটালে যায়, তাদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, কেউ বা হাসপাতালেই শেষ হয়ে যায়। আমি যদি আর না ফিরি, তবে তো সব কিছুর মীমাংসা হয়েই গেল। কিন্তু যদি সুস্থ হয়ে যাই - তখন কী করব আমি? হসপিটালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে এই কঠিন প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে। কী করব? কোথায় যাব? শরীরের করোনা যদি বা দূর হয়, সম্পর্কের করোনা? তার কী হবে? মা, বাবা, বাড়ির লোক কাউকে তো বলতে পারব না। ডাক্তার দাদাকেও না। শুধু নিজের মনে চিন্তা, নিজের সাথে লড়াই। অবশ্য যদি চিন্তা করার মত শরীরের অবস্থা থাকে।

অনু চুপ করে। হাঁপায়। তারপর আবার কথা বলে-
- আরেকটা কথা। তোমার যদি সিম্পটম দেখা দেয়, চিকিৎসা শুরু করতে দেরী কোর না।

আবার স্তব্ধতা। ঘর জুড়ে। বিশ্ব সংসার জুড়ে।

তখনই সমস্ত স্তব্ধতাকে খান খান করে দরজার বেলটা বেজে ওঠে। শেখর চমকে ওঠে। বাইরে সিকিউরিটি গার্ড বিজয়ের গলা।
- স্যার, অ্যাবুলেন্স এসে গেছে।


অলংকরণঃ কল্লোল রায়

ফেসবুক মন্তব্য