তখনও বল্কলে কলকাতা।
আঁশ ছাড়ালে কান্না। ভোর
রাতে ফাইন আর্টসের সাউথ
গ্যালারিতে বহুদিন
আগের দেখা বিমূর্ত নীল।
এগরোল পাঁচ আঙুলে বেঁধে
হাঁটতে হাঁটতে নন্দন,
রবীন্দ্রসদন, অতর্কিতে
জীবনানন্দ সভাগৃহের
দরজা ঠেলে চলকে পড়া।
হরিয়ানায় বৃষ্টি পড়ে না
বারোমাস।চাতকের চোখে
জল পড়ে অহরহ। বহুঢের
প্রতীক্ষার পর টুপ
কিংবা টাপ পড়লে যদি
সোঁদা গন্ধ খাপে খাপ
মিলে যায়, তখনও চোখে রিম
কিংবা পৌনে চারেক ঝিম।
কলকাতার মতো কিছুই সজল
মাখন নয়। ঢের সবুজ
কিন্তু শুকনো সবুজ।
ধুলোর চেয়ে বালি বেশি।
সবে দুবছর তখন। কলকাতা
থেকে সিঁদুরে কপাল নিয়ে
গুরুগ্রাম। চৌকাঠের
ভিতর বাইরে দুই
ক্ষেত্রেই, ক্রম ঠাওরের
পালা চলছে। জম থেকে
জমাট যাত্রী জীবন।
ডিসেম্বরের এস্কিমো
পোষাক, তারপর দুটো
কম্বল, পায়ে উলের মোজা,
তাও অহরহ হিমসূচে হাড়ে
হাড়ে এমব্রয়ডারি। হঠাৎ
গিজার নয়ন থেকে বিগলিত
নোনতা। জীবনে প্রথমবার
ঠান্ডা লাগছে বলে
কান্না!
আবার মে'তে যখন হাড়
পাঁজরা দগ্ধে দগ্ধে
পুড়ে জীবাশ্ম, তখন
কান্না গরম লাগছে বলে।
প্রথম একলা
দুর্গাপুজো। মাত্র
একটা ঠাকুরের সামনে
চারটে সকাল, দুপুর,
বিকেল... সেই সন্ধ্যে হলে
অফিসের ব্যাগ যখন
বাড়ির আলনায় মাথা এলিয়ে
দিত, তখন কমলা সুন্দরী
শাড়ি পরত, খোঁপা বাঁধত
একেকদিন একেকরকম। পাশে
আনকোরা পাঞ্জাবী
পাজামা। একেকদিন
একেকরকম। তখনও দেড়
দুঘন্টা মেট্রো করে
অগ্রজ কবির ড্রয়িং রুমে
কবিতা পড়তে চোখ আবছা।
স্টেজ নয়, ড্রয়িংরুম!
প্রবাসী কবি,
বহির্বঙ্গের কবি, বৃহৎ
বঙ্গের কবি, দিল্লির
কবি, সুদূরের কবি... এইসব
শব্দবন্ধেরা তখনো
অকথ্য উত্তপ্ত
আলকাতরার মতো। কানের
ভিতর দিয়ে তারা মরম
পরশিলেই একটা ক্ষতের
পিচ - ঢালা রাস্তা তৈরি
হোত। তখনও সুখ ছিল দুঃখ
ছিল অভ্যেস ছিল না।
এভাবেই পিঁয়াজবর্ণা
ভোর এক একটি খোসা
ছাড়াচ্ছিল। এমন সময়ে এক
সকালে মায়ের ফোন। লাল
শাকে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন
দিয়ে ঝুরো ঝুরো করে
নেড়ে পোস্তদানা ছড়িয়ে
নামিয়ে নিতে হবে। পাশের
বাড়ির মেজো পাঞ্জাবী'র
বৌয়ের বাচ্চা হবে।
পাড়ায় এবার কে কে
মাধ্যমিক আর
উচ্চমাধ্যমিক দেবে,
তাদের লিস্টি, ঋতুপর্ণ
ঘোষ মারা গেছে।
পঁচাশি'র সুধীন জেঠু
রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে
গিয়ে এখন বিছানায়,
উল্টো দিকের
দাশগুপ্তদের বাড়ির
নতুন টিয়াপাখিটা কথা
বলতে শিখেছে...
সুধীন জেঠু... ঋ...
মাধ্যমিক... পর্ণ
অভিনন্দন কার ছেলে?
ঋতুপর্ণ...
উচ্চমাধ্যমিক...
অভিনন্দন... কার যেন
ছেলে... মরে গেল?
ঋতুপর্ণ... টিয়াপাখিটার
মাথা ঘুরে গেছে... কী করে
মারা গেল? না
টিয়াপাখিটা কথা বলছে,
ঋতুপর্ণ মরে গেল। কেন
মরে গেল? রিমোট কোথায়?
রিমোটটা? রিমোটটা কই?
কোথায় যেন থাকে? টিভির
কাছে। সুধীন জেঠু পড়ে
গেছে। ঋতুপর্ণ মরে
গেছে? ঋতুপর্ণ মরে গেছে!
ঋতুপর্ণ মরে গেছে।
প্যানক্রিয়াস, বাবা মা
আগেই। টিয়াপাখি,
টিয়াপাখি... এই তো সেদিন
চিত্রাঙ্গদা দেখে মনে
হল, লোকটার নিজের সঙ্গে
নিজের ঝগড়া শেষ হয়েছে।
লোকটা অবশেষে নিজের
কাঁধে হাত রেখেছে।
বিল্ডিংকে বিল্ডিং কেন
বলে টিয়াপাখি? যখন
কন্সট্রাকশন চলছে, যখন
সমস্তটা বিল্ট হয় নি,
তখনও কেন বিল্ডিংকে
বিল্ডিং বলে? কারণ ইটস
এন অনগোয়িং প্রসেস।
চিত্রাঙ্গদা'র শেষে
এমনই একটা ডায়লগ ছিল না!
আসলে পূর্ণতা বলে কিছু
হয় না। হয় না। ঘরে ফেরার
চেষ্টাটুকু চালানো যায়
বড়জোর। লোকটা নিজের
ঘরে ফিরছিল। এমন সময় কে
ডাকল? নাকি এটাই তার ঘরে
ফেরা। কাদামাখা নুপুর
ধুয়ে যাচ্ছে। কবিতাটা
অলকানন্দা জলে অতলের
দিকে ভেসে যাচ্ছে। আমরা
কেউই তার সাক্ষাৎ পেলুম
না। বাথরুমে ঢুকলাম।
কাজরী ডাকল হাতছানি
দিয়ে... কাজরীর মাথা
নেড়া। মুখখানা কমবয়েসী
রেখার মতো। সবুজ
পাঞ্জাবী পরে সে মুখে
আঙ্গুল দিয়ে চুপ দেখিয়ে
ইঙ্গিত করল সামনের
দিকে। দেখি,
তারকোভস্কির অরণ্যে
একটা বিছানা। সেখানে
ঘুমিয়ে আছে সুধীন জেঠু।
তার মুখে নন্দ'র মা
হরলিক্সের চামচ
ঠেকাচ্ছে, একবার দুবার
তিনবার... সুধীন জেঠু
চুকচুক শিশুর মতো...
কাজরী আমাকে নিয়ে চলল,
সে কী স্টকার? 'ওদের' চোখ
এড়িয়ে নুনের
মরুভূমিতে...
আমরা দুজন... আমি তো
মিষ্টি খেতে ভালোবাসি।
এই নুনের সমুদ্রে... আমরা
কী করছি? আমি আর স্টকার...
কিংবা আমি আর কাজরী... সে
অন্ধের অরণ্যে চোখ বুজে
ঢিল কেন ছোঁড়ে... আমি
ভুরু কুঁচকে সেই দিকে
তাকালে সে কেন বলে, চুপ
কর অবিশ্বাসী, এগিয়ে
চলো, দেখতে পাচ্ছো না?
না, এখন পাচ্ছো না।
কিন্তু আরেকটু এগোলেই
পাবে - Zone. যা -ই Zone, তা-ই
চিত্রাঙ্গদা - The crowning wish-
তাইই সুবর্ণরেখার চর...
চিরায়ত মামা ভাগ্নে...
অপু দুর্গা - ফোর
হান্ড্রেড ব্লোজ খেয়েও
নাছোড় মালিক উঠে
দাঁড়ানো ছেলেটা - সবারই
ঐ এক লক্ষ্য।
ছুটছি, আমরা ছুটছি,
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ জেগে
উঠেছেন, দরজার ফাঁকে এক
টুকি রাগ দিয়ে গেল
দুর্গা। দুর্গার আলতা
ছাপ ধপধপে সাদা মেঝেয়
ছড়িয়ে দিচ্ছে ছুট -
কারুকার্য। দুর্গাও
আমাদের সঙ্গে ছুটছে,
আমরা দুর্গার সঙ্গে
ছুটছি, এঁয়োরা লাল উলু
দিচ্ছে, আমরা সাদাকালো
ছুটছি, পিছনে
তারকোভক্সির বাড়িতে
বৃষ্টি পড়ছে আর আগুন
উঠছে। তারকোভস্কি'র মা
পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখছেন
অকাতরে, তারকোভস্কির
বাড়ি কোথায়.. অমৃতসর,
চট্টগ্রাম অসম আউসুইচ
গাজা জেরুজালেম
মায়ানমার... ঠাওর করতে
পারছি না.. হঠাৎ আমার
হাতে ঝাঁকুনি... কাজরী
বলছে সময় নেই, পিছু
ফেরার সময় নেই, সামনে
দেখো, মহাযাত্রা শুরু
হয়েছে। তাই তো! ঋতুপর্ণ
বেরিয়ে পড়েছেন। জমকালো
কালোতে। মহাপালঙ্কে
মহাযাত্রায়।। মাথায়
কালো বন্ধনী। রাজকীয়
সমভিব্যাহারে
চলেছেন...
একা... জিজ্ঞেস করলাম... ওর
দাড়িটা কামিয়ে দিল কে...
অগম্ভীর আর্তনাদে বেজে
উঠল কলিং কোয়েল...
ফেসবুক মন্তব্য