আমাদের সোনালী বেলা

লিপিকা সরকার

যখন আমার খুব মন খারাপ করে, বিষন্নতা ঘিরে থাকে শীতের কুয়াশার মত আমি নিজেকে নিয়ে চলে যাই আমার শৈশবের দিনগুলিতেॠ¤ এক একটা দিন যেন গলা সোনার রঙে রাঙানো। সিন্দুক খুললেই ঝুলি থেকে বেড়িয়ে পড়ে কত কি যে খেলা! বুড়ি বসন্ত, কুমির ডাঙা, মাংসচুরি, ঘুড়ি ওড়ানো, আরো কত কি! আজ মনে চলে গেছে ঐ দূর দিগন্তে যেখানে লাল, নীল, সবুজ কত রং এর উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি র মত।

আমাদের বেড়ে ওঠা ঝাড়গ্রাম নামে একটি সুন্দর মফস্বল শহরে। সত্যি বলতে এই বিশ্বকর্মঠপূজোর দিন যে ঘুড়ি ওড়াতেই হবে এইরকম ব্যাপারটা অজানাই ছিল আমাদের। তবে এই বাতাসে পূজো পূজো গন্ধ এলেই ঘুড়ি উড়ত আকাশে।। সে এক অনাবিল আনন্দ, আনন্দযজ্ঞ ও বলা যেতে পারে। শুরু হত পয়সা জমানো দিয়ে, ঘুড়ি, লাটাই, সূতো কেনার জন্য ঠাকুমার, বাবার পাকা চুল বেছে, পুরানো খাতা বিক্রী করে, লজেন্স খাওয়ার পয়সা বাঁচিয়ে কৌটো ভরে জমানো হত পয়সা। দিনের শেষে সব ভাইবোনরা মিলে কৌটো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখা হত কতটা ভরেছে, কৌটো ভরে এলে সবার মুখের সেই হাজার টাকার হাসিটা আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই।।

এবার ঘুড়ি, সূতো, লাটাই কেনার ধূম, ২ পয়সার ঘুড়ি কিনতে গিয়ে কি আনন্দ যে কুড়িয়ে এনেছি তা আজও অশেষ। এবার মান্জা দেবার পালা, বিশাল কর্মযজ্ঞ। সাধারণত: রবিবার দেওয়া হত মান্জা। মনে আছে আমাদের বাড়ীর লাগোয়া একটা ফালতি গলি ছিল ওখানেই হত সব।

টিফিন খেয়েই আমাদের দলের যারা লেগে পড়তাম কাজে। আমাদের দলের পান্ডা ছিল আমাদের পিসতুতো দাদা সোনাদা, তার কথা মত চলতে হত আমাদের, না হলেই কপালে জুটত চুল টানা, কান মোলা, দল থেকে বাতিল করে দেবার মত কঠিন হুমকি! ব্যথা পেলেও চিৎকার করা ছিল বারণ কারণ তাহলেই বাবার মার আর সব পন্ড।

কত আয়োজন মান্জার। একদিকে আঠা জ্বাল হত, ময়দার আঠা, বাবলা কাঁটার আঠা, শিরীষের আঠা। একদিকে চলত কাঁচ গুঁড়ো করা। এইসব কাজ শেষ হলে মান্জা দেওয়া শুরু হত। মনে আছে আমার বোন একদিকে একটা লাটাই ধরে রাখত আর আমি আরেক দিকে। আর ছেলেরা হাতের মধ্যে কাগজে আঠা, কাচের গুঁড়ো নিয়ে সূতোর মধ্যে লাগাত টানটান করে, কড়া মান্জা হওয়া চাই। কতদিন হাত কেটে গেছে ওদের, তাতে কষ্টের চেয়ে আনন্দ হত বেশী কারণ বলাই বাহুল্য, মান্জা হয়েছে খাসা।। সেদিন স্নান খাওয়া দাওয়া সব নিয়মের বাইরে, মা-বাবা মাঝেমধ্যে বকলেও তাঁদেরও যে নীরব প্রশয় ছিল তা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে।

এবার আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর পালা, ও সে কি উত্তেজনা! ঘুড়ি উড়ল আকাশে, লাটাই দাদাদের হাতে, আমাদের নিষ্পলোক চোখ আকাশে,আর মুখে চলছে বিশেষজ্ঞেঠ° মতামত।

মনের মত না উড়লেই নামিয়ে আনা হত, কাগজ দিয়ে ঠিক করা হত কার্ণিশ। আবার পতপত করে আকাশে উড়ত ঘুড়ি। লাল, নীল, সবুজ, কোনটার আবার লম্বা লেজ। বেপাড়ার ঘুড়ি সামনে এলেই কাটার লড়াই। সে কী ভীষণ যুদ্ধ, একবার ঘুড়ি উপরে ওঠান, একবার নীচে। প্যাঁচ লেগে গেলে অন্যের ঘুড়ি কাটার চেষ্টা। অন্যেরটা ভো কাট্টা হলে সে কী লাফানো। চিৎকার। কঠিন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। কাটা ঘুড়ি ভাসতে ভাসতে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে আর আমরাও দৌড়েছি তার পিছন পিছন, নাগালে পাওয়া গেলে সে উপরি পাওনা। উল্লাস দিনভোর।

আর নিজেদের ঘুড়ি কাটলে চলত পোষ্টমর্টঠম, কার দোষ, কেন হল, আগামী দিন কি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে গম্ভীর মুখে চলত আলোচনা। আমরা বেশী কথা বলে মনোসংযোগ নষ্ট করার দোষে ঘোরতর দোষী সাব্যস্ত হতাম প্রায়শই তাতে দাদাদের মান রক্ষা হত। আর সবশেষে ঘুড়ি কেনার পয়সা না থাকলে, বাবার কাছে পয়সা চেয়ে বিমুখ হলে অগত্যা খবরের কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে পরের দিনের মান রক্ষার লড়াই এর প্রস্তুতি চলত জোরকদমে।

এই ছিল আমাদের ঘুড়ি বেলা।

ফেসবুক মন্তব্য