পাকাপাকি ভাবে
কোলকাতায় চলে আসার আগে
আমার মাতৃকুলের বাড়ী
ছিল সুখচরে যেখানে আমার
মা আর মামার জন্ম।
তাঁদের এক বিশাল বাগান
ছিল সুখচরের সেই বাড়ীর
লাগোয়া আর সেখানে এমন
এক বাঁশঝাড় ছিল, যা
আড়ে-দীঘে বসতবাড়িটির
পেছনে বহুদূর অবধি এক
অদ্ভুত ঘন প্রেক্ষাপট
তৈরি করেছিল।
এসব আমার জন্মের অনেক
আগের কথা। আমি
কস্মিনকালেও সেই
বাগানবাড়ি দেখিনি,
এমনকি যুবক হওয়ার আগে
অবধি সুখচর জায়গাটা যে
কোথায় তাও জানতাম না,
সেখানে যাওয়া বা থাকার
কথা তো দূর-অস্ত।
সুখচরের ‘মামারবাড়ি’
বলতে আমার যতটুকু ধারণা
বা আন্দাজ তার সবই কিছু
মলিন হয়ে আসা ব্ল্যাক
অ্যান্ড হোয়াইট ফটো,
যার ফসিলগুলো আজো আমার
প্রিসাস জিনিসের
কালেকশনের মধ্যে রাখা
আছে। আমার সেই অমূল্য
ভান্ডারের মধ্যে এখনো
খুব যত্নে আছে দাদুর
মানিব্যাগ, কুরুশে বোনা
দিদিমার নক্সাদার
টেবিল ঢাকা, মামার গীতা,
বাবার চশমা এবং আমার
মা’র হাতে লেখা অনেক
চিঠি । জন্মাবধি
‘মামারবাড়ি’ বলতে মধ্য
কোলকাতার সেই
মেটে-গেরুয়া রঙের দোতলা
বাড়িটার কথাই মনে পড়ে
যেখানে আমার শৈশব,
কৈশোর এবং যৌবনের অনেক
অলৌকিক দিন কেটেছে।
পরিণত বয়সে সুখচরের
সম্পত্তি বেচে দিয়ে
দাদু তাঁর দুই ছেলে
মেয়ে আর দিদিমাকে নিয়ে
কোলকাতায় চলে আসেন যার
নেপথ্যের সঠিক কারণ
আমার আজও জানা নেই।
ছোটবেলায় দিদিমা’র
কাছে যতটুকু শুনেছি
তাতে বোঝা গেছে সুখচর
ছেড়ে আসার জন্য দিদিমার
মনে এক গাঢ় অভিমান ছিল।
মাঝে মাঝে কারণহীন ভাবে
দাদু আর দিদিমা’র কথা
বন্ধ হয়ে যেত, অথবা সেই
সময় আমার পক্ষে বোঝা
সম্ভব হত না হঠাৎই আমার
সবচেয়ে প্রিয় দুটি
মানুষের কথা বন্ধ হওয়ার
কারণটা ঠিক কী!
২)
একতলা-দোতলা মিলিয়ে মোট
সাতটি ঘরের মধ্যে
বারো-বাই-চোদ্দ সাইজের
একটা ছোট ঘর দাদু বেছে
নিয়েছিলেন নিজের জন্য।
দুটো বেশ বড় বড় জানলা,
একটা কুলুঙ্গি, একপাশের
দেওয়াল ঘেঁষে দাদুর
শোয়ার খাট আর অন্যপাশে
একটা মস্ত কাঠের টেবিল।
এছাড়াও ছিল আরো তিনটি
কাঠের চেয়ার, যেগুলো পর
পর রাখা থাকত সেই বিশাল
টেবিলটার একদিকে।
বিভিন্ন বয়সের অনেক
ছাত্র-ছাত্রী আসতো
দাদুর কাছে ইংরাজী পড়তে
আর তখন বাড়ীতে যেখানে
যত চেয়ার, চওড়া টুল মায়
মোড়া অবধি... সব নিয়ে আসা
হত দাদুর ঘরে। ঐ বিশাল
টেবিলের যে প্রান্তে
দাদু বসতেন তার উল্টো
দিকে বসতেন তাঁর সব
ছাত্র-ছাত্রীরা।
ঘরের কুলুঙ্গিতে
অন্যান্য প্রয়োজনীয়
জিনিসের মধ্যে রুলটানা
কাগজের ছোট তিনটি খাতা
থাকত যেগুলোর ওপরে বড়
বড় অক্ষরে দাদুর হাতে
লেখা শিরোনাম... রজকের
খাতা, পরামাণিকের খাতা
এবং জমাদারের খাতা।
বিমানদা ছিলেন সেই
তথাকথিত রজক বা চলতি
কথায় ধোপা। বিমানদা
প্রত্যেক সপ্তাহে
একবার এসে তাঁর সঙ্গের
বিরাট বোঁচকাটি আমাদের
বৈঠকখানায় রাখতেন । তার
ভেতরে আমাদের অঞ্চলের
বিভিন্ন বাড়ী থেকে
সংগ্রহ করা কাপড়-চোপড়
কেচে, ইস্তিরি করে এবং
ভরে নিয়ে আসতেন। রঞ্জন
পরামাণিকও হপ্তায়
একবার আসতেন বাড়ীর
সকলের নখ আর দরকার
অনুযায়ী পুরুষদের
চুল-দাড়ি কাটতে।
কোলকাতা কর্পোরেশনের
মাইনে করা জমাদার ছিলেন
গোপালদা। প্রায় পাঁচ
দশক আগের কোলকাতায় কাক
ডাকা ভোরে বিভিন্ন পাড়া
থেকে ছোট ছোট কীর্তনের
দল বেরত। সেই দলের
সদস্যরা বেশিরভাগই
সাদা পোশাক পরে
কীর্তনাঙ্গের ‘রাই
জাগো, রাই জাগো’ গেয়ে
আশেপাশের রাস্তাগুলো
প্রদক্ষিণ করতেন।
সেইসব রাস্তার ধারের
হাইড্র্যান্টে
হোসপাইপ লাগিয়ে
কোলকাতা কর্পোরেশনের
তরফ থেকে শহরের
রাস্তাঘাট ধোয়া হত।
সেসব কাজের শেষে
গোপালদা আমাদের বাড়ীতে
আসতেন উঠোন এবং পায়খানা
পরিষ্কার করার কাজে।
এদের সকলকে পরিবারের
অঙ্গ, নিজেদের লোক বলেই
জানতাম। দরকার পড়লে
ধমক-ধামক দেওয়া এবং
প্রয়োজনে কানমলাও
খেয়েছি এঁদের কাছে।
কোন কাজকেই ছোট করে না
দেখার শিক্ষা বোধহয় সেই
ছোটবেলা থেকে আমি এঁদের
কাছ থেকেই পেয়েছি।
৩)
ছোট থেকে মামার বাড়ী
গেলেই দিদিমা কিছুতেই
ছাড়তে চাইতেন না আমায়
আর আমারও এক দিকহারা
আকর্ষন ছিল দিদিমার
ওপর। অনেক বোঝানো, অনেক
অনুনয় বিনয় করে
বাবা-মা’র কাছ থেকে
দিদিমা আমাকে চেয়ে
নিয়েছিলেন। সে প্রায়
ভিক্ষা করে নেওয়ার মতো
একটা ব্যাপার ছিল। সেই
হিসেবে ছোটবেলা থেকে
মামার বাড়ীতে থাকার
সুবাদে দাদু-দিদিমার
সম্পর্কের
টানাপোড়েনের যতটা
সাক্ষী ছিলাম আমি ততটা
বোধহয় আমার মা-বাবা
অথবা আমার একমাত্র
মামাও ছিলেন না। সেই
সম্পর্কের গাঢ়ত্ব,
অভিমান, বিশ্বাস এবং
অনুচ্চারিত প্রেম এখনো
আমাকে মাঝেমাঝে
প্রলুব্ধ করে যাতে
অন্তত স্মৃতির সিঁড়ি
বেয়ে সেই কালে পৌঁছতে
পারি যেখানে এখনো
প্রাণভরে দম নেওয়া যায়।
যদিও দাদুর বাবা একজন
বিদগ্ধ উচ্চাঙ্গ
সঙ্গীত প্রেমী ছিলেন
এবং আমার মা ও সেই
প্রেরণায় বিয়ের আগে
দীর্ঘদিন মার্গীয়
সঙ্গীত এবং পরে
রবীন্দ্রসঙ্গীত
শিখেছিলেন কিন্তু আমি
আমার দাদুকে কোন দিনই
গান গাইতে বা এ
সম্বন্ধে উৎসাহ প্রকাশ
করতে দেখিনি। তবুও
একদিন আমায় ডেকে নিয়ে
দোতলায় ছোট ছাতের ঘরে
এসে হঠাৎই গান গাইতে
শুরু করেছিলেন দাদু।
সে গানে সুরের তেমন
বৈশিষ্ট্য ছিলনা আর তার
লিরিকও তখন আমার
সম্পূর্ণ অজানা।
আজো মনে পড়ে দাদু চোখ
বন্ধ করে গাইছেন...
‘যমুনে এই কি তুমি সেই
যমুনা প্রবাহিণী,
যার রূপের তটে ব্রজের
হাটে, বিকাত নীলকান্ত
মণি...’
হঠাৎই গান থামিয়ে চাপা
স্বরে আমায় বললেন,
‘চুপিচুপি নীচে নেমে
দেখে আয় তো তোর দিদিমা
শুনছেন কি না!’ হাসি
চেপে দিদিমাকে সে কথা
জানাতে দিদিমা’র শান্ত
মুখে কয়েকটি রেখা তৈরি
হয়েই মিলিয়ে গেল চকিতে।
হালকা রঙ লাগা মুখে
জনান্তিকে বলে উঠলেন,
‘মরণ’।
এরপর থেকে দেখা গেল
হঠাতই দাদুর গান গাওয়ার
উৎসাহ বেড়ে গেছে
দ্বিগুণ। দাদু একদিন
যথারীতি গানে বসলেন সেই
ছোট ছাত সংলগ্ন ঘরে এবং
উঁচু গলায় ধরলেন তাঁর
গান। তখন দাদু-দিদিমার
কথাবন্ধের পালা । দাদুর
গান শুনে হাসি পাচ্ছে
আমার... সেই আগের মতোই
মাঝপথে থেমে গেল গান।
ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে
দাদু ধীর স্বরে বললেন,
‘সন্তু, একবার নীচে
নেমে দেখে আয় তো তোর
দিদিমা শুনছেন কি না!’
দোতলার লম্বা বারান্দা
পেরিয়ে, ঘোরালো সিঁড়ি
বেয়ে, পা টিপে টিপে নীচে
নামতে নামতে শুনতে
পেলাম দাদু’র এক অনন্য
গান ...
‘দুটি কথা কি তোমার
প্রাণে সয় না ! এক ঘরে ঘর
করতে গেলে ঝগড়া কি গো
হয়না !’
৪)
আজ দাদু-দিদিমা, বাবা-মা,
মামা কেউ নেই। প্রৌঢ়
প্রহরীর মতো সেই শূন্য
বাড়িতে আমি একা বসে
থাকি। বিকেল পেরিয়ে
সন্ধে নেমে আসে ছাতের
কার্নিস বেয়ে।
সময়ের সঙ্গে মানাতে
পারিনা। কতকিছু যেন আর
আগের মতো নেই। অন্ধকার
গাঢ় হয়। ছাতের এককোণে
বসে মনে হয় চারপাশে
ভেঙ্গে পড়ছে কতকিছু। ভয়
করে, প্রাণপণে স্মৃতি
আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি
সামান্য ঘাসের আঁটির
মতো।
ক্রমশঃ ক্ষীয়মান সেই
পুরনো গানের সুর ভেসে
আসে কানে।
দাদু গাইছেন...
... ‘দুটি কথা কী তোমার
প্রাণে সয়না!
একঘরে ঘর করতে গেলে
ঝগড়া কী গো হয়না!
ফেসবুক মন্তব্য