অবিশ্বাস্য প্রতিটি
সন্ধেয় বাড়ি ফেরার পথে
এ প্রান্তিক শহরে তোমার
সম্মোহন
ফেলে আসা সময়ের কূজনে
ভর করে
এখনও চাবুক স্পর্শের
কাজ করে
বাবা,
কি ভাবে শুরু করি বলো তো?
চোখের সামনে চলমান
স্মৃতি ভেজা দৃশ্যপট।
তোমার মুখেই শোনা।
কালিপুজোর রাতে জন্ম হয়
আমার। মেডিকেল কলেজ
থেকে আমায় দেখে বেরিয়ে
আসছিলে তুমি আর শক্তি
কাকু, হঠাৎ কাকু বললেন
তোমাকে, " প্রসূন লিখে
রাখ, আজ থেকেই শুরু হল
তোর উড়ান।"
কি জানি, সত্যিই উড়ান
শুরু হয়েছিল কিনা, তবে
আমি জন্মেছিলাম
'প্রিম্যাচিওর বেবি'
হিসেবে। ডাক্তার
বলেছিলেন, "এ মেয়ে
সারাজীবন ভুগবে।" তাই
বোধহয় শারীরিক
অসুস্থতা আমার
চিরসঙ্গী।
আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছ
বছর। আমাদের শরত
ব্যানারজী রোডের
বাড়ীতে বসেছে
রবিবাসরীয় আড্ডা। সেই
আড্ডায় রয়েছেন সমরেশ
বসু, মনীন্দ্র রায়,
সাগরময় ঘোষ সহ আরও
অনেকে।
তুমি আমায় বললে, "
রুম্পি, একটা কবিতা
শোনাও কাকুদের। "মনে
আছে বাবা? আমি কী কবিতা
শুনিয়েছিলাম?" হ্যাঁ,
সুকুমার রায়ের আবোল
তাবোল থেকে 'বাবুরাম
সাপুড়ে' কবিতাটি।"
তুমি সেদিন দুপুরে
পার্ক স্ট্রীটের
'প্যারাগন' থেকে আমায়
বিশাল বড় একটা ডল কিনে
দিয়েছিলে।
ছোটবেলা থেকে তোমাকে
আইডল মেনে এসেছি, আজ
এতগুলি দশক হাঁটলাম
পৃথিবীর বুকে, কিন্তু
কই? তোমার মতো কাউকে
পেলাম না তো আর?
প্রসূন বসু একজনই... এবং
তিনি অনন্য।
আমার জীবনের প্রথম এবং
একমাত্র ধ্রুবতারা।
ভাই ছিল মায়ের চোখের
মণি। ভাইকে চোখে
হারাতেন মা, জীবনের শেষ
দিন পর্যন্ত, আর হবে নাই
বা কেন? ভাই যে মাকে নতুন
জীবন দিয়েছিল। এতদূরে
থেকে আমি সেভাবে আর কিই
বা করতে পারলাম বলো
তোমাদের শেষ সময়ে! এও কি
কম আক্ষেপ আমার!
জীবনটা আসলে সত্যিই বড়
কঠিন। তাই
আয়ারল্যান্ডে একা
সন্তান মানুষ করার
জোরটাও পেয়েছিলাম
তোমাদের কাছ থেকেই।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর
শিক্ষা দিয়েছিলে তুমি,
ছোটবেলা থেকেই... তাই
নিজের পড়ার খরচ
চালিয়েছি টিউশনি করে।
মনে আছে? আমার প্রথম
মাইনের টাকায় তোমার
জন্য জরিপাড় ধুতি আর
সিল্কের পাঞ্জাবী কিনে
দিয়েছিলাম। মায়ের জন্য
শাড়ি আর ভাইয়ের জন্য
টাইটান-এর ঘড়ি।
ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে
হাজার নক্ষত্রের
আনাগোনা ছিল, সেও
তোমারই সূত্র ধরে।
সুভাষ জেঠুরা (কবি
সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
না-হয় থাকতেন পাশের
পাড়ায়, কিন্তু দূর
দূরান্ত থেকে আসতেন আরও
কতশত উজ্জ্বল আলোক।
তাঁদের সান্নিধ্যেই
বেড়ে ওঠা আমার। আর এসবই
তোমার কন্যা বলেই।
শনিবারের দুপুর।
কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়
প্রেসিডেন্সী কলেজের
সামনের ফুটপাথের
স্টলগুলিতে ঘুরে
বেড়াচ্ছি তুমি - আমি।
আমি তখন যাদবপুর
ইউনিভার্সিটি। বাংলা
প্রথম বর্ষ। ইতি উতি
ঘুরছি দুজনে, তুমি
খুঁজছো রেয়ার বই, অথচ
পাচ্ছো না মনোমতো। আমি
বায়না করছি, "বাবা চলো
না, Paramount এর সরবত খেয়ে
আসি।"
হঠাৎ তুমি স্ট্যাচু।
"বাবা? কি হল?" আমি
জিজ্ঞেস করছি...
"পেয়েছি রুম্পি,
দ্যাখ।"
হ্যাঁ সেদিন আমরা
পেয়েছিলাম সেই রেয়ার
বইটা...'মৃত্যুর পরে ও
আত্মার কথা'... আমাদের
প্রকাশনা সংস্থা
'নবপত্র প্রকাশনের'
অন্যতম বেস্ট সেলার।
বইয়ের প্রতি আগ্রহটা
তোমায় দেখেই। বাড়িতে
বসেও শুধুমাত্র বইয়ের
সাহায্যে সারা পৃথিবী
ঘুরে বেড়ানো যায়, এই
কথাটা তুমিই গেঁথে
দিয়েছিলে মনে। মাত্র
চার বছর বয়েসেই 'আবোল
তাবোল 'এর প্রায় সব
কবিতাই কণ্ঠস্থ ছিল
আমার। মনে আছে সেই মজার
ঘটনা?
তোমার মুখেই শোনা।
আমাদের বিল্ডিং এর
সামনের দিকের দোতলায়
থাকতো দক্ষিণ ভারতীয়
সেশু'রা। প্রতি
মঙ্গলবার প্রার্থনা
হতো ওদের বাড়ি। পিসীর
সাথে একদিন আমিও গেছি
ওদের বাড়ি। প্রার্থনা
সভায় সকলের চোখ বন্ধ,
মনে মনে জপছেন তাঁরা
মন্ত্র, বিড়বিড় মুখ
নড়ছে। আমারও মুখ নড়ছে...
পিসী মুখের কাছে গিয়ে
কান পেতে শুনলেন, আমি
বাবুরাম সাপুড়ে
আওড়াচ্ছি।
২০০৫, ডাবলিন
এয়ারপোর্ট। ভাই এবং
পুত্র স্বস্তি কে নিয়ে
তোমাকে আর মা কে রিসিভ
করতে আমরা অপেক্ষারত
লাউঞ্জে... বিকেল সাড়ে
পাঁচটায় এর ল্যান্ডিং...
দ্বিতীয়বার ডাবলিনের
মাটিতে পা রাখা তোমার,
এবং সেই শেষবারও।
সকালের রুটিন ছিল, আমার
বাড়ির পাশেই ফেয়ারভিউ
পার্কে নাতি কে নিয়ে
মর্নিং ওয়াক, ফিরে
ব্রেকফাস্ট, তারপর
ডাবলিন ঘুরতে বেরনো,
কখনও আমি সঙ্গিনী, কখনও
বা ভাই, আবার কখনও তুমি
একাই। ফেনা ভাত আর আলু
সেদ্ধ তোমার প্রিয়
খাবার হলেও, এখানে এসে
আমার হাতের রান্না খুব
তৃপ্তি করে খেয়েছিলে।
স্মৃতি রোমন্থনের একটা
সমস্যা হল, তা সহজেই
ওভারল্যাপিং করে। আগের
কথা পরে, আর পরের কথা আগে
চলে আসে। আসলে স্মৃতিকে
শৃঙ্খলা রক্ষার ভার
দেওয়া চলে না কোনমতেই।
মুহূর্তের ভয়েস ওভার
জুড়ে
এখন ফেলে আসা সময়ের...
আদুরে মেঘমল্লার
তোমার জন্ম হয় সাহেব
সুবোদের বিশেষ দিন
বড়দিনে। আজও তাই ২৫ শে
ডিসেম্বর আমার চোখে
ক্রিসমাস নয়, তোমার
জন্মদিন হিসেবেই ফিরে
ফিরে আসে। যীশুর
জন্মদিনে জন্ম বলেই কি
যীশুর সাথে এতটাই মিল
তোমার? তাই কি হাজার
আঘাতেও একটি বারের
জন্যও প্রত্যুত্তর
করোনি? চেয়েছিলে তারাও
বদলে যাক? কিন্তু তারা
যে প্রসূন বসু নয় বাবা।
জীবনটা শেষ হয় সেখানেই,
যেখান থেকে একদিন শুরু
হয়েছিল। ছোটবেলায়, পড়তে
বসে আটকে গেলেও একই কথা
বলতে তুমি, "সমস্যার
সমাধানের জন্য আবার
ফেরৎ যাও সেখানে, যেখান
থেকে শুরু করেছিল।"
তাহলে কি আমার জীবনও
শেষের দিকে চলতে শুরু
করেছে? তাই কি অ্যালবাম
বন্দী মুহূর্তগুলি
একের পর এক এসে
দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে?
ফেসবুক মন্তব্য