খেলাচ্ছলে ছেলেখেলার
সেই দিনগুলোর (ছেলেখেলা
শব্দটি নেহাতই শব্দ
হিসাবেই ব্যবহার
করলাম। ছেলে বা মেয়েকে
আলাদা করা বা কাউকে
বেশি গুরুত্ব দেওয়ার
জন্য নয়) কথা লিখতে বসে
এক লহমায় হারিয়ে গেলাম
কল্লোলিনী শহর ছেড়ে
বর্ধমানের সেই অজ
গাঁয়ে, যেখানে শৈশবের
এক অপাপ আনন্দে একদল
দামাল ছেলেমেয়ে মাতিয়ে
রাখত বকুল তলা, খড়ি ও গৌর
নদীর দুইপাড়, জমিদার
বাড়ির পরিত্যক্ত গোপাল
বাড়ি, কখনোবা গৌরিপিসির
আম, জাম, কাঁঠাল ও আঁশফল
ঘেরা প্রশান্তির সেই
চিরসবুজ বাগান। সাড়া
বছর জুড়েই থাকত নানান
রকম খেলার ঝাঁপি।
উল্লেখযোগ্য ছিল
ঝালঝাপটি, খেটে খেলা,
নুনধাপসা, খেলনাবাটি,
লুকোচুরি, ঘটিং, যুগ,
পাতা পাতানো, মার্বেল,
এছাড়াও ডাংগুলি,
চু–কিতকিত,
এক্কাদোক্কা, চোরপুলিশ
এগুলোতো ছিলই। খেলার
উপকরনের জিনিসপত্র
পেতাম বাড়ির মা, জেঠিমা,
ঠাকুমা, পিসিমাদের
ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত
জিনিস ও প্রকৃতির কাছে
থেকে পাওয়া অমূল্য সব
সম্পদ থেকে। সারা বছর
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এইসব
খেলাগুলোই চলতো। তবে
বেষ্ট প্লেয়িং-সিজন ছিল
শীতকাল।
আমাদের তখন ডিসেম্বরে
অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে
যেত। তারপর আর আমাদের
পায় কে! পাকা ধানের ফসল
আর খেজুরগুড়ের গন্ধ
মাখা ‘ম’ম করা উত্তুরে
হাওয়ার সাথে পাল্লা
দিয়ে নানান খেলার রঙিন
দিন। ঝাল ঝাপটি হল
গাছের উপর উঠে নিচে
ঝাঁপ দেওয়া। কে কতগুলো
ঝাঁপ দিতে পারলো সেই
হিসেব থেকে সেইদিনের
বিজয়ী বা বিজয়িনী
নির্ণয় করা হত। তবে সেই
বকুল গাছটি ছিল ছোটখাটো
ফলে পা বা হাত মচকানো বা
ভাঙার সংখ্যা কম হত।
একই প্রক্রিয়া চলত নদীর
পাড়ে এঁটেল মাটির পাড়
জল দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে
সেখান থেকে গড়িয়ে নিচে
জলে ঝাঁপ। তবে শীতের
নদী শান্ত, এবং জল থাকত
কম, তাই তিনিও কোল পেতে
আমাদের মতো দামালদের
অত্যাচার সহ্য করতেন
নীরবে।
খেটে খেলা নামের মধ্যেই
খাটুনির কথা আছে। একটা
নির্দিষ্ট দুরত্বে
রাউন্ড করে একটা বৃত্ত
আঁকা থাকবে এবং দুটো
দলে ভাগ হয়ে একজনকে
বসিয়ে তার মাথা ছুঁয়ে
অন্য দলের সবাইকে ছুঁতে
হবে একই সঙ্গে যাকে
বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে
ওই বৃত্তের মধ্যে পৌঁছে
যাওয়ার রাস্তা করে দিতে
হবে অন্য দলকে এড়িয়ে।
যুগ খেলা হল প্রচুর
পরিমাণ ভাঙা কাঁচের
চুড়ি দিয়ে। একটা বড়
বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢেলে
দেওয়া হত চুড়িগুলোকে।
একটা মাত্র আঙ্গুল দিয়ে
অন্য চুড়ির
টুকরোগুলোকে স্পর্শ না
করে টেনে টেনে একটা
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে
কে কতগুলো রঙ বেরঙের
চুড়ি নিজের কাছে জমাতে
পারলো তা দেখা হত।
নুন ধাপসা হল
বর্গক্ষেত্র বা
আয়তক্ষেত্রের মতো বেশ
কয়েকটা ঘর বানিয়ে এক
একটা ঘরে এক একজন
থাকবে। এক্ষেত্রেও সেই
দুটো দল থাকবে, যারা
ঘরের মধ্যে আছে তাদের
কাজ যারা আটকে রেখেছে
তাদের ফাঁকি দিয়ে
সবগুলো ঘরে যেতে হবে।
যারা পাহারায় আছে তাদের
কাজ বেরোনোর সময় তাদের
ছুঁয়ে দিতে হবে। ছুঁয়ে
দিলেই সে আউট।
খেলনাবাটি আর পুতুল
একসাথে পাঞ্চ করে খেলা
হত এবং ছেলে মেয়ে সবাই
খেলতাম একসাথে। মাটি বা
পুকুরের পাঁক তুলে এনে
ছোট ছোট বাউন্ডারী ওয়াল
দেওয়া হত সেগুলো আমাদের
ঘর। পুতুলগুলো আমাদের
সংসারের সদস্য। আমাদের
খাদ্য হিসাবে ব্যবহার
হত ধুলো, ধুলো মানে তখন
আর ধুলো নয়, সেগুলো
ভাত।
ঘটিং হল বালি, কাঁকড় ও
মাটি শুকিয়ে নানান
আকৃতির গোল গোল জিনিস
যেগুলো হত আমাদের মাংস,
তেলাকচুর পাতা জল দিয়ে
চটকে জেলির মতো থকথকে
জিনিস বানানো হত ওটা
আমাদের দই। অতসী ফুলের
বীজ হলো ডাল এবং ফেলে
দেওয়া নারকেল মালা,
মাটির ভাঁড়, বট,
অশ্বত্থের পাতা রান্না
করা ও খেতে দেওয়ার
পাত্র হিসাবে ব্যবহার
হত। সবাই একসাথে বসে
ওইসব উপাদেয় খাদ্য
খাওয়ার সময় জিভ ও
টাগরায় স্পর্শ করে এক
অদ্ভুত শব্দ করতাম যা
দিয়ে বোঝাতাম আমরা
খাওয়া দাওয়া করছি। এত
কিছু কান্ডের পর আমাদের
একদিনের সংসার শেষ হত।
একদিন হঠাৎ করে নিজে
হাতে গড়া সংসার ফেলে
চলে আসতে হল বাবার কাছে
কোলকাতায়। আসার দিন
ভোরবেলায় অমূল্য
কোত্থেকে এসে হাজির,
কয়েকটা রঙিন পাথর আমার
হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘এগুলো তোর, নদীর পাড়ে
কুড়িয়েছিলাম মনে আছে?’
দুজনেই হাপুস নয়নে
কাঁদছি তখন। স্মৃতির
অলস দুপুরে সেসব দিনের
কথা মনে পড়লে আজও
শব্দহীন শিশিরের মতো
চোখ দিয়ে টুপটাপ ঝরে
পরে গহীনে লুকিয়ে থাকা
খেলাময় সেই ছেলেবেলা।
ফেসবুক মন্তব্য