আমাদের ছোটবেলাটা
সত্যিই সাদামাটা ছিল।
সাদামাটা, শান্ত,
আনন্দের আতিশয্য
কিন্তু ছিল অতি সামান্য
বিষয় ঘিরেই।আমরা উঠোন
থেকে মাটি খুঁড়ে, বা
পুকুর পাড় থেকে মাটি
তুলে এনে এক সহজ
পদ্ধতিতে পুতুল
বানাতাম। উপরে একটা গোল
মুন্ডু, নীচে একটা সহজ
শেপের ধড়। ঝাঁটার কাঠি
দিয়ে দাগ দিয়ে দিয়ে
চুল আর শেষে একটা
একরত্তি পুঁটলির মতো
খোঁপা। কুমকুম দিয়ে
সিঁদুর মাস্ট। তারপর
তাকে রোদ্দুরে শুকিয়ে
মায়ের থেকে ছেঁড়া
পাড় জোগাড় করে শাড়ি
পরানো। ছেলে পুতুলের
দিকে কারো ঝোঁক ছিল না।
ওগুলো নিয়ে সামনের
বাড়ির পেয়ারা গাছের
নীচে আমরা খেলতাম।
তেলাকুচার ফল দিয়ে
তরকারি, আর লুচিপাতা
দিয়ে লুচি। মিথ্যে
রান্না বান্নার জলে ইঁট
ঘষে মশলা পড়তো।মাটি
দিয়ে একটা ছোট্ট উনুন
বানিয়ে দিয়েছিল আমার
মামা। সে উনুন নিয়ে
গর্বের সীমা ছিল না।
মিথ্যে রান্নার মধ্যে
মাঝেমাঝে আমাদের ক্লাস
সেভেন এইটে পড়া দিদিরা
এসে ঢুকে পড়ে সত্যি
রান্না শুরু করে দিত।
দুটো ইঁট পেতে মাঝখানে
কাঠকুটো জ্বালিয়ে
প্রথম যেদিন আমাদের
গাছের তলার
বন্ধু-সংসারে সত্যি ভাত
ফুটলো আনন্দে আত্মহারা
হয়ে গিয়েছিলাম। সেই
ভাত পরমান্নের মতো আমরা
ফ্যান আর নুন দিয়ে
খেয়েছিলাম।
আমাদের সবচেয়ে মজার
দিন হতো পাড়ায় ফিস্ট।
প্রথমে কার বাড়িতে হবে
সেটা ঠিক হতো। তারপর সব
বন্ধুরা চাল, ডাল, হলুদ,
নুন, লঙ্কা, ডিম, আলু,
পিঁয়াজ নিয়ে যেতো।
আর কেউ শুধু মিষ্টি
আনতো।
তারপর হতো সেই
নানারকমের কোয়ালিটির
চালের ও ডালের খিচুড়ি,
ডিম ভাজা, পিঁয়াজি,
বেগুনী। কোন একজন বা
দুইজন পাড়ার কাকিমা
রান্নার দায়িত্ব
নিতেন।আমরা বহুদিন
তাদের কাছে কৃতজ্ঞ
থাকতাম।ওই রান্নার
সময়টুকু আমাদের
গ্রুপের কিছু
করিৎকর্মা মেয়ে ছিল,
যারা হাতে হাতে
কাকিমাদের সাহায্য
করতো, আমার মতো ভ্যাবলা
যারা তারা লুকোচুরি
খেলতো। তারপর রাত সাড়ে
নটা বাজলে লাইন দিয়ে
ধমক লাগিয়ে বাবারা
ফেরত নিয়ে আসতো। এরকম
চাল, ডাল নিয়ে গিয়ে
ফিস্ট আমার জীবনে বড়
বেলায় আর ফেরেনি।
আমাদের পাড়ায়
রবীন্দ্র জয়ন্তী হত
পঁচিশে বৈশাখেই। মানে
পরিকল্পনা তাই থাকতো।
প্রতি বছর ওইদিন ঝড় জল
হতো মারাত্মক। আমরা
সকাল থেকে চুনের কৌটো
লুকিয়ে রাখতাম যাতে
বৃষ্টি না আসে। কিন্তু
সন্ধেবেলায় আমরা
সাজগোজ করে নেওয়ার
পরেই ঝড় উঠতো। স্টেজ
যেন উড়িয়ে নিয়ে
যাবে। গাঢ় বৃষ্টির
মধ্যে বাবার কোলে করে
সাজগোজ ধুতে ধুতে আমি
কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি
ফিরতাম। হাতের আলতা
ধুয়ে বাবার শার্ট
বাতিল হত। আবার ডেট ঠিক
হতো। দু তিনবার বদলেছে,
এমন ও হয়েছে। কিন্তু
ওই রবীন্দ্র জয়ন্তী
নিয়ে একটা গোটা পাড়ার
ছেলেমেয়েরা পরস্পরের
সঙ্গে ছমাস বেঁধে বেঁধে
থাকতো। এর চেয়ে বড়
প্রাপ্তি আর কিছু ছিল
না আমাদের। আমাদের
রিয়ালিটি শো এর চমক
ছিল না, কোন আলোর আকর্ষণ
ছিল না। সাদামাটা একটা
স্টেজে পাড়ার সব
বাচ্চারা মিলে ঋতুরঙ্গ,
শ্যামা, চন্ডালিকা,
তাসের দেশ করতো। বড়রা
খুব বেশি মাত্রায়
ইনভলভড ছিল নৃত্য
নাট্যে। নিজেরাই সাজতো
সবাই। মায়েরা সাজিয়ে
দিতো। কদাচিৎ ড্রেস
ভাড়া করা হয়েছে। আমরা
পিসবোর্ড কেটে ঢাল
তলোয়ার বানাতাম।
রাঙতা লাগাতাম তার
উপরে। সারা বছর ধরে
রাঙতা জমাতাম বড়দের
সিগারেটের প্যাকেট
থেকে।
একটা সুন্দর বেবি ডল
সেট ছিল আমার। পুতুলের
বিয়ে দিয়েছিলাম।
সাতজন বন্ধু খেয়েছিল
লুচি-ছোলার ডাল,
মিষ্টি। বড়মামা ছোট
একটা খাট, আলমারি, আর
মশারি বানিয়ে উপহার
দিয়েছিল। জীবনে প্রথম
ধনী মনে হয়েছিল। আমার
ঘরে যে ধন আছে, বন্ধুদের
ঘরে সে ধন নেই। বড়মামা
নিজের হাতে বানিয়ে
দিয়েছিল বলে বহুদিন
বড় মামাকে ঘুম থেকে
উঠেই মনে মনে
বলতাম,"ভালোবাসি।"
এই ঘটনাটাই আমার পুরো
ছোটবেলার একমাত্র বলার
মতো লাক্সারি।
এখন সব আছে বাচ্চাদের।
একটা সরল ছেলেবেলা আর
কিছুতেই ধরেনা তাদের
সুসজ্জিত খেলনাঘরে!
ফেসবুক মন্তব্য