ছেলেবেলার খেলার গল্প

প্রণমিতা মুখার্জী

কাগজ আর কলমের আজ ভারি বন্ধুত্ব। মনের বাঁধন খুলে গেছে, শব্দের মালা আর মনের আকুতি দুইর পরিণয় ঘটেছে। সুর তাল মিলিয়ে উঠেছে যে ঝংকার তারি প্রকাশ এই গল্পমালা।ঘটনাচক্রে আজ আমি তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে উপবিষ্ট, সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে চলেছি আর স্মৃতির মণিকোঠায় মুক্তের সন্ধানে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। ছেলেবেলার দুস্টমিষ্টি খেলা ধুলোর স্মৃতিচারণে মনের প্রশান্তি ফুটে উঠে ঠোঁটের মৃদু হাসিতে।
ছিলাম আমরা তিনটি খুদে প্রাণ - বয়সে আমিই সবার বড়। সরলতার ছোঁয়া ছিল আমাদের মনে প্রাণে। প্রতিটি দিন ছিলো এক একটি আডভেণচার।
আমাদের তিনজনের বাবাই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের অধ্যাপক। সেই সুবাদে বাসস্থান ছিল কাছাকাছি, বড়ো হয়ে ওঠা গ্রামের খোলামেলা জলহাওয়ায়। আমাদের বাড়ির সামনে ছিলো একটি ছোট্ট নালা, সারাবছর শুকনো থাকলেও বর্ষাকালে সেই নালার রূপ ছিলো একেবারেই অন্যরকম। ছোটদের মনে সেই নালাকে ঘিরে ছিল অনেক পরিকল্পনা- তখন সবে সবে বাড়িতে তালিম মিলেছে কাগজের নৌকো বানানোর। এমনও হয়েছে কাগজওলা বাড়িতে নতুন কাগজ দিয়ে যাওয়ার পরেই তা আত্মসাৎ হয়ে রূপ নিয়েছে কাগজের নৌকোয়।
যাই হোক সেই রকমই বেশ কিছু কাগজের নৌকো বানিয়ে আমরা রওনা দিলাম নালার উদ্দেশে। বলাই বাহুল্য, বড়োদের এই ব্যাপারে কিছুই জানানো হত না। আমাদের এই অভিযানের মাথা ছিলাম আমি। কিন্তু ওই বয়সে চুল আঁচড়ানো আর শীতকালে উলের টুপি দেওয়া ছাড়া মাথার আর কিছু কাজ ছিলো বলে জানা ছিলো না।
নালার ধারে পৌছোলাম, একে একে তিন জনের নৌকো জলের উপরে শোভা পেতে লাগল, নিজেদের অনেকটা গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া নাবিকদের মতন মনে হতে লাগল।
এইভাবেই চলতে থাকতো খেলা আর স্বপ্নের জগতে পাড়ি দেওয়া। কিন্তু বড়োদের খুব বেশিদিন আমাদের স্বপ্নের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা গেল না। আমাদের কনিষ্ঠ সদস্য একবার নৌকো ভাসাতে গিয়ে নিয়ে এলো বিপর্যয়। যে নালা বড়োরা এক লাফে পার হয়ে যেতে পারতেন, আমরা ছোটরা তাকেই ভাবতাম সমুদ্র। আমাদের ছোট্ট সদস্য নৌকোর সাথে নিজেও কিছুটা এগিয়ে যেতে গিয়ে ঘটালো বিপত্তি। টাল সামনাতে না পেরে সে নিজেও জলের ওপর গিয়ে পড়ল। অকস্মাৎ এই বিপর্যয়ে আমরা বাকি দুই বন্ধু খানিকক্ষণ কিম্ভুতকিমাকার হয়ে থাকলেও পরক্ষণেই আমাদের তারস্বরে চিৎকার আর ছোট্ট সদস্যের বিপুল ক্রন্দন ধ্বনিতে তিনজনের পুরো পরিবারের উপস্থিতি, প্রবল বকুনির বারিবরষণের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট সদস্যের ডাঙায় পুনরাবির্ভাব এবং এর পরেই নৌকোভিযানের সাময়িক স্থগিত ঘোষণা যে হবেই এ তো বলাই বাহুল্য।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ওই ঘটনার পরে আমরা তিন জনেই একটু সংকুচিত হয়ে পড়লেও আমাদের পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা ছিলো সমান্তরাল। আর সে অভিযান ছিলো জঙ্গলাভিযান। সে গল্পে আসার আগে দুস্টমি ভরা খেলাধুলোর আর একটি মুহূর্ত আপনাদের দরবারে নিয়ে আসি। লোকশ্র্রতি ছিলো আমি বড়ো শান্ত, তারই কিছু নমুনা এইরকম। বাড়িতে ছিলো হস্তচালিত সেলাই মেশিন। বাড়ির এককোণে চুপ করে পরে থাকা মেশিনের জন্য মনে মনে একটু করুণার আলোড়ন হওয়ায় একদিন সকলের অলক্ষে মেশিনের কাছে গিয়ে উপবিষ্ট হলাম। সেলাইয়ের সরঞ্জামের নাগাল না পাওয়ায় নিজের সবথেকে খুদে অঙ্গুলিকে ব্যবহারের অভিপ্রায় জাগল মনে। সেলাই মেশিনের ছুঁচের তলায় নিজের খুদরো আঙ্গুলটিকে বেশ মানিয়েছে। গ্রীষ্মের ক্লান্ত অপরাহ্ন, চারিদিক নিশ্চুপ, মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। চাপ পড়লো মেশিনের হাতলে, চাকা ঘোরার সাথে সাথেই নিশ্চিন্ত দুপুরের রেশ কেটে গিয়ে আকাশ বাতাস আলোড়িত হয়ে উঠল এক অতি শান্ত খুদে থুরি বিচছুর সুরের মূর্ছনায।আপনাদের চোখ মুখের বর্তমান পরিস্থিতির কিছু আভাস অনেক দূরে বসেও কল্পনা করতে পারছি।
জঙ্গলাভিযান গল্পে আসি। নৌকাভিযানের সাময়িক সমাপ্তির পরে আমাদের পদধুলি পড়ে গ্রামের শেষ প্রান্তের জঙ্গলে। জঙ্গল সাফাইয়ের লোকজন ছাড়া কাউকে ওই জঙ্গলে কখনো ঢুকতে দেখিনি। বাড়ির সকলের নজর উপেক্ষা করে এক নিস্তব্ধ দুপুরে আমরা পাড়ি জমালাম সেই জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। লাল এবং হলুদ ফলের গাছ আগে থেকেই সনাক্ত করে রাখাছিলো তাই চডুইভাতির উপকরণ হিসেবে একটি ঝুড়িতে অনেকখানি করে ফল সংগ্রহ করা হলো। খড়ের গাদা ছিলো কাছেই, মাটিতে পড়ে থাকা খড়ের আঁটি দিয়ে বিছানা করে সেখানে দশ পনেরো বার গড়াগড়ি খাওয়ার পরে তিনজনেই জলের সন্ধানে বেরোনোর প্রয়াস নিতে উদ্যোগী হলাম। এমনসময়ে এলো বিপত্তি। হঠাৎ প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হোলো একটি কুকুর। আমাদের উপস্থিতি যে সারমেয়টির প্রত্যশার বাইরে তা তার গলায় আওয়াজেই প্রকাশ পেলো। তার ভয়ে আমরা খুদে অভিযাত্রীর দল তাড়াতাড়ি খড়ের গাদার মস্তকারোহণ করতে বাধ্য হলাম। কিছুটা দূর হাঁচড় পাঁচর করে ওঠার পর একজনের পদস্খলনের দরুন বাকি দুইজন পপাত ধরণীতলে। সারমেয়টি তখন জুলজুল চোখে আমাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা অবলোকন করে পুলকিত প্রাণ। আমাদের সর্বাঙ্গ তখন খড়ে ঢাকা এবং অসহ্য চুলকোনি। সারমেয়টির সাথে শুভদৃষ্টি আমাদের কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছিলো তা বলতে পারি না, তবে সম্বিত ভাঙল তার গগনভেদী চিৎকারে। উর্ধশ্বাসে দৌড়, তারস্বরে চিৎকার আর তিনজনের নিঃশ্বাসের আওয়াজকে সঙ্গী করে যখন বাড়ি পৌছলাম, ততক্ষণে সারা শরীরে খড়ের চুলকোনির রক্তিম আভা। বাড়ির আবহাওয়া তখন একেবারেই মনোরম নয়, তাই রংগীন ফলে সাজানো আদরের ঝুড়িটির সাথে সারমেয়টির বন্ধুত্ব কতোখানি গভীর হয়েছিলো তার খবর আর পাই নি।
এতবছর বাদেও ছেলেবেলার খেলাধুলোর স্মৃতিচারণে কি ভীষণ আনন্দ। স্বীকার করতেই হবে সেই সব দিন ছিলো "সব পেয়েছির দিনগুলি"। উপকরণের প্রাচুর্য ছিলো না,কল্পনার জগতে প্রবেশ ছিলো অবিরত। মনের মণিকোঠায় ছড়িয়ে থাকা হীরে মুক্তার সন্ধান মিলেছে, আর তাই দিয়ে যখন মালা গাঁথতে বসেছি,দেখি সুতোর দৈর্ঘ্য ক্রমবদ্ধর্মান। গল্পের ঝুলি এখনো খালি হয় নি। নিশ্চিত কথা দিলাম আবার ফিরবো আপনাদের আসরে কোনো এক দিন অর্ধসমাপ্ত এই ঝুলিটিকে নিয়ে।।

ফেসবুক মন্তব্য