আজকে প্রায় দুবছর পর
যখন হাফ সেঞ্চুরির
দরজায় পৌঁছে যাব সেই
বয়সে এসে মেয়ে হওয়ার
যন্ত্রণাগুলো
নতুনভাবে বুঝতে পেরে
হতাশ হই মনে মনে।
কত আর বয়স হবে তখন?
নার্সারিতে পড়ি
সেইসময়। আমাদের
পানিহাটিতে চিঁড়ের
মেলায় মা পাশের বাড়ির
দিদু, আর দুই পিসির সাথে
হুজুগে সেই মেলায় গেছে।
স্কুল থেকে ফিরে মাকে
না পেয়ে আমার অভিমান
আকাশ ছোঁয়া। পাশের
বাড়ির দাদু যিনি বাবার
বাল্যবন্ধুর বাবা তিনি
আমাকে কল পাম্প করে
বালতি করে জল দিয়ে
বললেন যে হাত পা ধুয়ে
নিতে। আমি জেদ করে
যাচ্ছিলাম না কিন্তু
দাদুর অনুনয়ে যেতেই হল
আর দইচিড়ে খেয়ে আমি
ঘুমিয়ে গেলাম। দাদু
নাকে নস্যি নিয়ে
ততক্ষণে বাড়িতে পড়তে
আসা ছাত্রছাত্রীর জন্য
বারান্দায় বসে আছে।
দাদুর কাছে প্রচুর
ছেলেমেয়ে পড়তে আসত।
আমিও দাদুর সাথে তাদের
শাসন করতাম। ঘুম ভেঙ্গে
আমি বোর হয়ে সারা হাতে
পুঁই পিটুলির রস মেখে
যেন হোলী খেলছি। পাকা
পুঁই পিটুলি টিপছি আর
লাল রস এসে সাদা টেপ
জামায় ছিটকে এসে রঙ করে
দিচ্ছে। নেশার মতন এইসব
বদমাশি করছি। দাদু পিছন
থেকে এসে কান মুলে দিলে
আমার সেকি কান্না। আমার
অপমানবোধ বাচ্চাবেলা
থেকেই চূড়ান্ত। দাদুর
হাত থেকে নস্যির ডিবে
নিয়ে ছুঁড়ে নর্দমায়
ফেলে দিয়ে থমথমে মুখে
বসে আছি। দিদু এসে
যতক্ষণ না দাদুকে বকে
দিল আমার মুখ একেবারে
রাগে লাল।
আমাদের পাড়ায় সেইসময়ে
কারোর স্কুটার ছিল না।
পাশে রাখীদের বাড়িতে কে
একজন ওদের চেনাজানা
এসেছিল স্কুটার চড়ে।
রাখী বিল্টু দুই ভাইবোন
তা চড়ে ঘুরছিল দেখে
আমাদেরও কয়েকজনের ভারি
ইচ্ছে হয় তা চড়ার জন্য।
সেই ভদ্রলোক যাকে রাখী
শান্তুকাকু বলে ডাকছিল,
সে আমাদেরও কাকু হয়ে
গেছিল। তারপর পাড়াতে
আসলেই দুজন তিনজন করে
আমাদের স্কুটারে করে
ঘুরিয়ে আনত।
শান্তুকাকু আজ কোথায়
আছে জানি না। এক জীবনে
কম গাড়ি, ফ্লাইট চড়িনি
কিন্তু জীবনে প্রথম
স্কুটারে ভ্রমণ
শান্তুকাকুই
করিয়েছিল।
আমার মামা আর ছোটকা ছিল
আমার সবচেয়ে কাছের
বন্ধু। তাদের সাথে
পিকনিকে যাওয়া, সিনেমা,
সার্কাস দেখতে যাওয়া।
আমার পিসতুতো দাদার
সাথে আমার খুনসুটি ছিল।
দাদা আমাকে বাবা অঙ্ক
না পাড়ার জন্য বকছিল
বলে হাসছিল। পরেরদিন
পেনের ঢাকনি খুলে সাদা
জামা তার উপরে রেখে
স্কুলে চলে গেছিলাম।
দাদা কলেজ যাওয়ার সময়
দেখে সাদা জামা সমস্ত
কালি শুষে নিয়েছে। এই
যে বাচ্চাবেলার
দুষ্টুমি, জেদ এগুলো
আমার ছিল ষোলোআনা।
পাড়াতে সবাই মিলে
লুকোচুরি খেলছি। বড়রা
ছোটরা সবাই আছি। দুটো
দল আমাদের। মৌসুমিদি আর
তপনদার দল। তপনদারা
গেছো ছেলে সব গাছে উঠে
ঘন গাছের পাতার মধ্যে
নিজেদের লুকিয়ে
নিয়েছে। গোপার পিসিদের
বিশাল বাগান ছিল আর ছিল
প্রচুর গাছ। আমরা
মেয়েরা খুঁজে খুজে
হন্যে হয়ে গেছি। আমি
খুঁজতে খুঁজতে
পুকুরপাড়ে চলে গেছি
তারপর পথ হারিয়ে ফেলে
হাউহাউ কান্না জুড়ে
দিয়েছি। তপনদা দেখি
আমার সামনে ফলসা গাছ
থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলল,
“তোর জন্য আজকের দানটায়
জিততে পারলাম না।
মেয়েরা এত ছিঁচকাঁদুনী
কেন হয় রে? চল, ওদিক দিয়ে
রাস্তা।” শীতের বিকেলে
কুয়াশা নামছে গাছের
পাতায়। অন্ধকার হঠাৎ
করে নেমে আসে। আমি
নিশ্চিন্তে তপনদার
পিছু নিই।
আজকে ছোটবেলার কথা মনে
হতে অনেক কথাই মনে
এসেছিল। অনেক মজার,
হাসির সেসব দিন কিন্তু
চারদিকের হাওয়া এখন
বড্ড অন্যরকম। তাই আমার
এই কথাগুলোই লিখতে
ইচ্ছে হল। আজকাল খবরের
কাগজ খুললেই বড্ড বেশি
শিশু নিগ্রহের খবর পাই।
শিশুরা অনেকক্ষেত্রেই
চেনাজানা লোকেদের
দ্বারাই নিগৃহীত হয়।
কতদিন আমার মা আর সুমির
মা সুমির কাকা বা আমার
ছোটকার কাছে আমাদের
রেখে সিনেমা দেখতে
গেছে। আমরা নিশ্চিন্তে
সারাদিন উঠোনজুড়ে
খেলেছি, আচার খেয়েছি,
গল্প করেছি, ঝগড়া
করেছি।
পিডোফাইল শব্দটা মনে হয়
আমাদের মায়েরা জানত না।
আমাদের মায়েদের কোনদিন
এসব নিয়ে আমাদের কিছু
বলতে হয়নি, কিছু বোঝাতে
হয়নি। এমন একটা
নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল
আমাদের পাড়া, আমাদের
ঘরবার। আজকে তাহলে
কেন...?
ফেসবুক মন্তব্য