নরম তুলতুলে
পেয়ারাগুলো মাথার কাছে
রেখে, মায়ের মাথায়
আস্তে করে হাতবুলিয়ে
অনীশ ডাকল, “এখন চোখটা
ক্যামন আছে মা?”
--“ওহঃ অনীশ তুই? কবে এলি
বাপ?”
--“কাল। গ্রামের বাড়ি
হয়ে ঘুরে এলাম। তোমার
চোখ ক্যামন তাই বলো।”
--“এখানে এসে, বাঁ-চোখটা
অনেকটাই ভালো। আমাদের
এই বৃদ্ধাশ্রমে রোজ
দুটো করে কাগজ আসে।
ভালোই ত পড়ে ফেলছি!”
--“তবে যে ইউ-এস-এর
স্পেশালিষ্ট দিয়ে
চেক-আপ করালাম! চশমা
লাগবে না, তা আগে বলতে হয়
ত?”
--“পুকুরটা ভেসে গ্যাছে
দেখলি? এবছর খুব বৃষ্টি
হচ্ছে রে!”
--“না। ছোট্কারা ওতে
লোক দিয়ে বাটামাছের
পোনা ছেড়েছেন শুনলাম।
টাকা দিয়েও এসেছি।”
--“জানিস, এবার ১লা
বৈশাখে ‘শিরিশছায়া’
আশ্রমের সব্বাইকে
আমাদের উত্তরপোতার
গাছের জাম খাইয়েছি! মিঃ
সুরেন্দ্রবাবুর সে কী
কান্না! উনি নাকি এই
দশবছরের মাথায় তাঁর
হারানো মেয়ের মুখখানি
মনে করতে পারলেন।
গাছগাছালিরাও কার
কীভাবে ঠিকুজী লিখে
রাখে... ভাব একবার!”
মোহিনী দেবী আর
কোনকিছুই জিজ্ঞাসা
করলেন না। না ওর বৌএর
কথা, না ওর ছেলের কথা, না
কর্মস্থল! ওর যে পুরনো
মাইগ্রেন আছে, সে
কথাটুকুও একটিবারের
জন্যেও জিজ্ঞাসা করলেন
না! তবু অনীশ নিজে থেকেই
বলে মাকে আনন্দ দিতে
থাকল, “তোমার ঘরের তালা
পালটে, নতুন তালা
লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। না
না কিচ্ছুতে হাত দেই
নি। পঁচিশটা গাছের
নারিকেল বিক্রির টাকা
তোমার বইতে তুলে
দিয়েছি। নেবুগাছে ফুল
এসেছে। নাড়ু খেতে ইচ্ছে
করলে দুমাস আগে বলো,
জামবাটি ভরে পাঠিয়ে
দেব।”
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল।
অনীশ বসে আছে মায়ের পা
ঘেঁষে। কাঁচের সার্সি
বেয়ে নীরবে নামতে লাগল
আকাশ ভাঙা বেদনা!
বহুদূর বিদেশ-বিভুঁইয়ে
পড়ে আছে অনীশের
অভিভাবকহীন ঘরদোর।
ঘরবাহির সামলানো একলা
সৈনিক বৌ। আর ঠাম্মি,
দাদুর আদর বঞ্চিত
অরোরা-রোদ্দুরমাখা
নিউক্লিও বেবি!
--“আজই চলে যাবি?”
অনীশ জানে, এই বয়েসে
কেবলমাত্র মায়ের পুকুর
ভেসে গেলেই, দুঃখ পান, আর
কিছুর জন্যে না! তবু সে
সহজভাবেই বলল,“হ্যাঁ
মা, আজই ফ্লাইট! না গেলে
সংসারটা ভেসে যাবে যে!
দেখে এলে ত সব!”
--“দেখলাম ত, দেশটা ভারী
বিশ্রী! এতো দৌড়ঝাঁপের
জীবন এখানে! একটা কাজের
লোক নেই যে, দুটো টাকার
বিনিময়ে তার কোলে
একবেলার জন্যে হলেও
বাচ্চাটা ছেড়ে দিয়ে,
নিশ্চিন্তে থাকা যায়!
এই শুনি এত্তো এত্তো
লোক, কোথায় থাকে রে
এরা?”
--“এটুকু কাজের জন্যে
ওদেশের সাধারণ
খেটেখাওয়া মানুষ পরের
বাড়িতে আসবার প্রয়োজন
বোধ করেন না মা! ওদের
নিজেদেরও পুত্র-পরিজন
আছে! তাছাড়া যতটুকু
জানি, এঁরা নিজেদের কাজ
নিজেরাই করে নিতে
অভ্যস্ত। সেইসাথে
যতদিন পারেন, এঁরা
একত্রে এক সংসারে
বাঁচবার চেষ্টা করেন!”
অনীশ উড়বার জন্যে উঠল।
চশমাটি বিছানার ওপর
পড়েই রইল। মোহিনী দেবী
কৌতুহলবশত একবার হাতে
নিয়েও, সাবধানে নামিয়ে
রাখলেন। এই চোখ নিয়ে আর
তিনি অ্যামেরিকা দেখতে
চান না।
ফেসবুক মন্তব্য