হোটেল থেকে হাঁটতে
হাঁটতে অমল সবে
দু-আড়াই কিলোমিটার
এসেছে, হঠাৎ বৃষ্টি
নামলো। সকাল সাড়ে
সাতটার নরম সোনালি
রোদের মধ্যেই। এক রকমের
খুব ছোটো ছোটো
ট্রান্সপারেন্ট পুঁতি
দিয়ে ছোটোবেলায়
দিদিদের ছুঁচে গেঁথে
কাপড়ের ওপরে সেলাই করে
ডিজাইন করতে দেখতো,
নাইলনের সুতোয় ভরে
আংটি-টাংটি বানাতে
দেখতো, ঠিক সেই রকমই
পুঁতির মতো বৃষ্টির
ফোঁটা। রাস্তার ধারে
সবুজ ঘাসে গাছের পাতায়
পড়ে সেগুলো গড়িয়ে
যাচ্ছে মাটিতে। ফলে
বৃষ্টি হলেও গাছগাছালি
যেন সেভাবে ভিজছে না।
অমল তবু রাস্তার ধারের
একটা লাল টুকটুকে একতলা
বাড়ির উঁচু
বারান্দাতে উঠে
দাঁড়ালো। কারুকাজ করা
বন্ধ প্রশস্ত সদর দরজার
সামনে কাঠের রেলিং ঘেরা
ছোট্ট বারান্দা, যার
দুদিকেই লাল সিমেন্টে
বাঁধানো সিঁড়ি।
বারান্দাতে দাঁড়িয়ে
সকালের প্রায় নির্জন
সরল রাস্তা, দুদিকের
লাল টালির ঢালু চালের
রঙ বেরঙের বাংলো, ঘন
নারকেল গাছের সারি,
পুঁতির মালার মতো
বৃষ্টি, বাড়িগুলোর
পেছন থেকে উঁকি মারা
সবুজ, এবং আরও পেছনে
সমুদ্রের উপস্থিতিতে
অতিরিক্ত উজ্জ্বল
আকাশের দিকে তাকিয়ে
থাকতে থাকতে হঠাৎ অমলের
মনে হল ও যেন আগেও এখানে
এসেছে। অথচ অমল জানে,
গোয়াতে এই ওর প্রথম
আসা।
বৃষ্টি থেকে বাঁচার
জন্য যে বাড়ির
বারান্দায় উঠে অমল
দাঁড়িয়েছিল ঠিক তার
সামনের বাড়িটার
বাহারি জাফরির নিচু
পাঁচিল ঘেরা বাগানের
মধ্যে একটা ছোটো গোল
বাঁধানো ফোয়ারা। তার
নিচে একটা সাদা
মারমেডের মুর্তি যেন ওর
দিকে তাকিয়েই বসে আছে।
অমলের চেনা লাগে
মুর্তিটাও। এমন কোনো
মুর্তিও যেন ও আগে
কোথাও দেখেছে! বাগান
শেষে বাংলো
প্যাটার্নের বাড়িটার
কাঠের রেলিং ঘেরা
বারান্দায় মুখোমুখি
চেয়ারে বসে চা বা কফি
খাচ্ছেন এক প্রৌঢ়
দম্পতি। বাগানের
গাছগাছালির আড়ালে
আবঝা তাদের অবয়ব। অমল
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
চারদিক দেখতে থাকে।
দেখা ওর স্বভাব। দেখতে
ও ভালোবাসে। রাস্তায়
লোক চলাচল বাড়ছে
ক্রমশ। বৃষ্টি যেমন
হঠাৎ এসেছিল তেমনিই
হঠাৎ থেমে গিয়ে ঝলমল
করে উঠলো চারধার। অমল
ঘড়ি দেখল, আটটা বেজে
গেছে। হোটেলে ফিরতে হবে
বলে ও বারান্দাটা থেকে
নেমে আসতেই, সামনের
বাড়িটার পাঁচিলে নিচু
কাঠের রেলিংএর দরজা
খুলে বেরিয়ে একটি মেয়ে
রাস্তায় উঠে অমলের
সামনে থেকে হেঁটে
উল্টোদিকে চলে গেল। বয়স
কুড়ি-একুশও হতে পারে,
আবার পঁচিশ-ছাব্বিশও।
খাকি ফুলপ্যান্টের
ওপরে লাল-আকাশি চেক
শার্ট গুজে পরা। অমলের
মনে হল কোনো ইউনিফর্ম
হবে। সামনে দিয়ে যাওয়ার
সময় মেয়েটি অমলের চোখের
দিকে একবার তাকালে অমল
দেখলো সরু চিবুকের
দুঃখি মুখের শ্যামলা
মেয়েটির চোখের রং
সমুদ্রের মতো সবজে নীল।
আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে
হল এই মেয়েটিও ওর চেনা।
অথচ, অমল জানে এই গোয়াতে
ও আগে কখনো আসেনি।
আর আগে কখনো আসেনি বলেই
দিল্লিতে রিভিউ মিটিং-এ
মহারাষ্ট্র রিজিয়নের
এচিভমেন্ট দেখে
চেয়ারম্যান যখন বললেন,
"মিঃ রয়, হোয়াই ডোন্ট
ইউ টেক দ্য চার্জ অভ
গোয়া স্টেট ট্যু?"
অমলের প্রথমেই আনন্দে
কণার কথা মনে হয়েছিল।
ক'দিন আগেই কণা বলছিল,
সাত-আট বছর হয়ে গেল
বম্বে আছি, তবু গোয়াটা
একবার যাওয়া হলো না।
বিয়ের পরে পঁচিশ বছর
ধরে উত্তরে দক্ষিণে এত
যায়গায় ঘুরলাম, কেউ
বিশ্বাস করবে আমরা
জীবনে কখনো গোয়া যাইনি!
তাছাড়া, প্রতিবার
অমলের ট্যুরে বেরোনোর
আগে কণার বিরক্তি, এমন
সব জায়গায় ট্যুরে যাও
কেউ কোথায় গেছো জানতে
চাইলে নাম বলতে পর্যন্ত
লজ্জা লাগে। ধুলে,
জলগাও, আকোলা, সাতারা,
সাঙলি...যত্তসব! অমলের
তাই প্রথমেই মনে
হয়েছিল, যাক, এবার বোধহয়
গোয়াট্যুরের সময় কণার
আর লোককে বলতে লজ্জা
করবে না। আর কোনো একবার
সময় সুযোগ মত ওকেও
সঙ্গে নিয়েই গোয়া ঘুরে
যাওয়া যাবে।
যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল
সে রাস্তা দিয়েই ফিরতে
গিয়েও একটা পাঁচ
রাস্তার মোড়ে এসে
বুঝতে পারে না ঠিক
কোনদিকে যেতে হবে।
সরুসরু মসৃন পিচের
রাস্তাগুলো যেন সব
একইরকম দেখতে। পথের
ধারের একটা ছোটো দোকানে
হোটেলের নাম বলাতে
দোকানদার পথ দেখিয়ে
দিল। জুন মাসের প্রথম
সপ্তাহে বর্ষা এখনো
সেভাবে আসেনি, তাতেও
সমস্ত পথের দুধারে
সবুজের সমারোহ। নানান
নাম না জানা ফুল ফুটে
আছে। দুটো সুন্দর
বাংলোর ফাঁক দিয়ে দেখা
যাচ্ছে পেছনের বিস্তৃত
জমিতে চলছে ধানের চারা
রোপনের কাজ, ঠিক যে
দৃশ্য একসময় ও নিজের
রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের
গ্রামে অনেক দেখেছে।
বেলা বাড়াতে, অমল লক্ষ
করে, রাস্তাঘাটে লোক
চলাচলও বাড়ছে। মোবাইল
বেজে উঠতে পকেট থেকে
ফোন বের করে অমল দেখলো
কণার ফোন। 'বিপি-র ওষুধ
নিয়েছ? প্যাকিং হয়ে
গেছে? কাজু কিনেছ তো?'
পরপর তিনটে প্রশ্ন করে
কণা, এক নিঃশ্বাসে। না,
কোনোটাই হয়নি। সকালে
উঠে ভাবলাম একটু হেঁটে
আসপাশটা দেখে আসি।
হোটেলে ফিরে প্যাকিং
করব। অমল হাঁটতে হাঁটতে
উত্তর দেয়।
দায়িত্ব নেওয়ার পরে
গোয়ায় এটাই অমলের প্রথম
ট্যুর। পানাজিতে ওর
অফিসের কাছে যে হোটেলে
উঠেছে তার জানালা থেকে
দূরে জলে ভাসমান নানান
মাপের ও আকারের
ক্যাসিনো দেখেছে। গত
দুদিন কাজের চাপে ওটা
সমুদ্রের খাড়ি না
মান্ডভী নদী তাও জেনে
নিতে পারে নি। গোয়ার
কোনো সৈকতেও যাওয়া
হয়নি। আজ তাই চলে
যাওয়ার আগে পায়ে হেঁটে
একটু আশেপাশে ঘুরে দেখে
নেওয়া। দুপুর একটায়
ফ্লাইট। আর গত দুদিনে
গোয়ার প্রায় কোনো কিছুই
দেখা হয়নি বলেই
ট্যাক্সি নয়, অমল ঠিক
করেছে আজ এখানকার
ব্রাঞ্চ ইনচার্জ
মনোজের মোটর-বাইকে ওর
পেছনে বসে এয়ারপোর্ট
যাবে। ইচ্ছে মতো পথে
দাঁড়াবে, ফটো তুলবে,
পারলে কোনো বীচেও একটা
চক্কর মেরে যাবে। আর
তাই, কথা হয়েছে সকাল
দশটায় মনোজ ওকে পিকআপ
করবে হোটেল থেকে।
মুম্বাই থেকে আসা নতুন
বসকে এমন সার্ভিস
দেওয়ার সুযোগ পেয়ে সেও
খুশি।
ব্রেকফাস্ট করে, বিপির
ওষুধটা খেয়ে ঠিক দশটাতে
চেকআউট করে অমল
রিসেপশানের লাউঞ্জে
এসে বসে। সঙ্গে লাগেজ
বলতে একটা পিঠে নেওয়া
যায় এমন ব্যাগ যাতে
ল্যাপটপ থেকে
জামাকাপড় সবই এঁটে
গেছে। 'টেকেন
ম্যাডিসিন', কণাকে
এসএমএসটা পাঠিয়েই মুখ
তুলে দেখে সামনে হেলমেট
পরে মনোজ কখন এসে
দাঁড়িয়ে আছে।
হোটেলের দারোয়ানের
হাতে একটা কুড়ি টাকা
গুঁজে দিয়ে বাইরে এসে
অমল বাইকে মনোজের পেছনে
উঠে বসে। দারোয়ানটা গেট
ছেড়ে এগিয়ে এসে অমলের
পিঠের ভাড়ি ব্যাগটা
অপ্রয়োজনেই একটু নেড়ে
চেড়ে যেন ঠিক করে দেয়।
চলু স্যার? মনোজ জানতে
চায়। অমল সম্মতি
জানাতেই মনোজ বাঁহাতে
ক্লাচ আলগা করে ডান
হাতে এক্সিলেরেটরে
মোচড় দেয়।
আকাশ পরিস্কার। একটু
বাদেই পানাজি শহরের
সীমানা ছাড়িয়ে,
কোর্তালিম ব্রীজ
ডিঙিয়ে ওরা এসে পড়ে
মাডগাঁও-ভাস্কো রোডে।
মসৃন চওড়া রাস্তা দিয়ে
ছুটে চলেছে বাইক।
দুপাশে সরে যাচ্ছে ছোটো
ছোটো পাড়ার মতো
জনবসতি। বাড়িগুলোর
বেশ একটা শ্রী আছে।
বিস্তীর্ণ বাগান ও
নারকেল গাছের
পটভূমিকায় কোনো কোনো
বাড়ি বেশ দর্শনীয় মনে
হয় অমলের। কোথাও কোথাও
রাস্তার দুধারেই চাষের
জমি, কোথাও বা বাওড়ের
মতো জল জমে আছে। দূরে
কখনো কখনো পাহাড়ের
ধূসর মাথা উঁকি দিয়ে
যাচ্ছে সবুজের পেছন
থেকে। এয়ারপোর্টে
যাওয়ার আগে ওকে একবার
বোগমালো বীচেও ঘুরিয়ে
নিয়ে যাবে বলেছে মনোজ।
অমলের বেশ ভালো লাগছিল।
কেন যে ও কখনো গোয়া
আসেনি আগে!
'স্যার, থোরা পেট্রল ভর
লেতা হুঁ,' বলে মনোজ
রাস্তার ধারে একটা
পেট্রল পাম্পে ঢুকে
লাইনে বাইক দাঁড় করিয়ে
দেয়। গাড়ি ও
টু-হুইলারের আলাদা
লাইন। ওদের বাইকের আগে
কতজন আছে দেখতে গিয়ে
অমল সকালে পানাজিতে
দেখা সেই ইউনিফর্ম পরা
নীল চোখের মেয়েটাকে
একটা বাইকে পেট্রল ভরে
অটোমেটিক মেশিন থেকে
বিল বের করে দিতে দেখে।
একইরকম ইউনিফর্ম পরা
আরো কিছু ছেলে মেয়েকেও
গাড়ির লাইনে কাজ করতে
দেখে। সকালের মতোই এখনও
মেয়েটাকে অমলের বড়
চেনা মনে হয়। একটা করে
বাইকের তেল ভরা হতে
থাকে আর অমল একটু করে
এগোতে থাকে মেয়েটার
দিকে। মেয়েটা যখন ডান
হাত দিয়ে
পেট্রলপাম্পের ফুয়েল
নজলটা প্রতিবার তেল
ভরার পরে মেসিনে হ্যাং
করে ডিসপ্লেতে পরের
কাস্টমারের থেকে জেনে
নিয়ে টাকার পরিমান টাইপ
করে আবার নজলটা তুলে
আনছিল, অমল মন দিয়ে
মেয়েটাকে লক্ষ করছিল।
মেয়েটার পরিপাটি করে
বাঁধা বিনুনী, ঘাড়ের
কাছের কুচো চুল, কানের
ছোট্টো লতিতে আভরণহীন
ছিদ্র, গলায় সাদা
পুঁথির সাধারণ মালাটার
চেক শার্টের ভেতরে ঢুকে
যাওয়া, মেয়েটির প্রায়
সমতল বুক এবং বাঁ হাতের
কনুইয়ের নীচের খয়েরী
জরুল। আর সবকিছুই যেন
বড় চেনা চেনা লাগতে
থাকে অমলের। মেয়েটা
একটা স্কুটারে তেল ভরতে
ভরতে পাশে ইউনিফর্ম ও
টুপি পরা একটা ছেলেকে
ঘাড় ঘুরিয়ে হিন্দিতে
বলল, খিদে পেলে আমার
ডাব্বা থেকে দুটো রুটি
খেয়ে এসো যাও। বলার
ভঙ্গি ও স্বরে মাখানো
আন্তরিকতা ও মমতাও
অমলের কান খেয়াল করে।
মনোজের বাইক ততক্ষণে
মেয়েটির সামনে। মেয়েটি
দুশো টাকা জেনে নিয়ে
পাম্প মেসিনে টাকার
পরিমান টাইপ করে নজল
হাতে এসে দেখে মনোজের
বাইকে
পেট্রলট্যাঙ্কের
ঢাকনাটা খুলছে না।
বারবার চাবি ঘোরানোতেও
কাজ হচ্ছে না। মেয়েটি
এতক্ষণে বাইকের পেছনে
বসা অমলের চোখের দিকে
তাকায়। সেই সমুদ্রের
সবজে-নীল দুটো চোখ। আর
মুহূর্তে অমলের মনে
পড়ে যায় মেয়েটিকে কেন
এত চেনা লাগছে!
নয়নতারা।
ঠিক তেত্রিশ বছর আগে
বরানগরের একটা মর্নিং
কলেজে অমলের সঙ্গে
বিএসসি পড়তে ভর্তি
হয়েছিল নয়নতারা।
বেলঘড়িয়া না পানিহাটি
থেকে আসতো। মেঘলা
আকাশের মতো ছিল গায়ের
রঙ। আর চোখ দুটো গাঢ়
সমুদ্রনীল। এ মেয়েটির
মুখের ডৌল, শরীরের গড়ন
মায় বাঁহাতের কনুইয়ের
জরুলটি পর্যন্ত যেন
হুবহু সেই নয়নতারার
মতো। অমল ভুলেই গিয়েছিল
নয়নতারার কথা। অথচ
ভোলার কথা তো ছিলনা।
অমল তখন দিনের বেলায়
বালীতে একটা ওষুধের
কোম্পানীতে চাকরী
নিয়েছে। নিতে হয়েছিল।
বাবার মৃত্যুর পরে মা ও
বোনের দায়িত্ব তখন ওর
ঘাড়ে। সকালে কলেজ করেই
ডানলপ থেকে তিন নম্বর
বাস ধরে সরাসরি চলে যেত
বালীর সেই ওষুধের
কোম্পানীতে। বেশিরভাগ
দিনই নয়নতারা নিজের
টিফিনকৌটো থেকে রুটি
বের করে খাইয়ে দিত ওকে।
বলতো, আমি তো বাড়ি
ফিরেই ভাত খাবো, তুই খা।
নয়নতারার চোখে সবসময়
যেন একটা গভীর বিষাদ
জড়িয়ে থাকতো। অমল
বুঝতে পারতো ওদেরও
আর্থিক অবস্থা ভাল নয়।
একবার ওরা ক্লাসের অন্য
সহপাঠীদের সঙ্গে দল
বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে
দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার
সময় ও সারাক্ষণ অমলের
বাঁহাতটা নিজের ডান
হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে
রেখেছিল। সেদিনই ফেরার
পথে আড়িয়াদহের একটা
ছায়াময় রাস্তার ধারে
একটা বহু পুরানো বাড়ির
সামনে ওরা দুজন
দাঁড়িয়েছিল। লোহার
দরজার ফাঁক দিয়ে ওরা
দেখতে পাচ্ছিল সেই
পুরোনো প্রাসাদোপম
বাড়ির সামনের বাগানে
নানান রকম গাছের আড়ালে
একটা গোল ফোয়ারা ও তার
নিচে একটা মারমেডের
মূর্তি। নয়নতারা
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতে বলেছিল, জানিস
আমার না মনে হয় আমি কোনো
এক জন্মে মারমেড ছিলাম।
সেই জন্মের
সমুদ্রস্মৃতিই আমার
চোখে লেখা আছে। না হলে
কেউ কখনো এমন কালো
মেয়ের নীল চোখ দেখেছে?
বলেই নিজের বাঁ হাতের
তর্জনী ও মধ্যমা নিজের
দু চোখের দিকে মেলে ওর
স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে
খিলখিল করে হেসে
উঠেছিল।
সেই নয়নতারা যার সঙ্গে
ওর ভালো করে কোনো
সম্পর্ক হওয়ার আগেই,
ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল
পরীক্ষাও তখনো হয়নি,
হঠাৎ একদিন কলেজে এসে
বলেছিল, জানিস আমার
বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আগামীকাল আশীর্বাদ।
অমলের তখন উনিশ-কুড়ি,
সবে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে
উঠছে এমন সহপাঠিনীর
বিয়ের সংবাদে কী
প্রতিক্রিয়া দেখানো
উচিৎ তাও বুঝতো না। ওর
প্রথমেই মনে হয়েছিল
নয়নতারা কলেজে না এলে
ওকে এখন থেকে খালি
পেটেই অফিস যেতে হবে।
বলেছিল, ইস্, আমাকে এবার
খিদে সহ্য করতে শিখতে
হবে রে। নয়নতারা চোখ
তুলে তাকিয়েছিল ওর
চোখের দিকে, অমলের মনে
পড়ে গেল, সে চোখে
কুয়াশা জমেছিল
হেমন্তের সকালের মতো।
সেদিন জুলজি ক্লাস না
করে ওরা দুজনে কলেজের
দোতলার ফাঁকা কমনরুমে
বসেছিল অনেকক্ষণ।
নয়নতারা জানিয়েছিল
যদিও বিয়ে হতে তখনো তিন
মাস বাকী কিন্তু তবু ও
আর কলেজে আসবে না।
ছেলেপক্ষ চায় না ও আর
পড়াশোনা করুক, তাও
আবার কোএডুকেশন কলেজে।
ওরা মন খারাপ করে
বসেছিল অনেকক্ষণ, তারপর
আস্তে আস্তে দুজনে
একটিও কথা না বলে
সিঁড়ি ভেঙে উঠে
গিয়েছিল ছাতে। না
কলেজের ছাতে যাওয়া যেতো
না। তালা লাগানো থাকতো।
সেই বন্ধ দরজার সামনেই
অমল ওর জীবনের প্রথম
চুমুটা খেয়েছিল।
নয়নতারার বন্ধ দুচোখের
পাতায় প্রথমে ঠোঁট
ছুইয়ে নিজের ঠোঁট
রেখেছিল ওর ঠোঁটে।
বিষন্ন চোখের নয়নতারার
মুখগহ্বরে যে এত উষ্ণতা
ছিল সেদিনই জানতে
পেরেছিল অমল। নয়নতারার
কানের লতির ঠিক নিচে
ঠোঁট ঠেকিয়ে ওর মেঘলা
আকাশের মতো ত্বকের
অচেনা এক নোনতা স্বাদ
জিভে তুলে নিতে নিতে
অমল বলেছিল, তোর সাথে আর
কখনো দেখা হবে না
ভাবতেই পারছি না রে।
রোগা নয়নতারা ওর
দুহাতের মধ্যে কেঁপে
উঠেছিল, ভিজে স্বরে
বলেছিল, দেখা হবে।
দেখিস, একদিন আমাদের
ঠিক দেখা হবেই। সে
দিনের পরে আর কখনো
কলেজে আসেনি নয়নতারা।
নয়নতারাকে ভুলতে অমলের
একমাসও লাগেনি।
ঐ বয়সের বেশিরভাগ
ছেলেদের যেমন মনে হয়,
সমস্ত মেয়েই যেন
সম্ভাব্য প্রেমিকা।
পিওর সায়েন্সের কণা
কিছুদিন পর থেকেই
স্বেচ্ছায় ওকে টিফিন
খাওয়ানোর দায়িত্ব তুলে
নিয়েছিল।
মেয়েটি একটা ছোট্টো পটে
করে ল্যুব্রিকান্ট এনে
মনোজের অয়েল ট্যাঙ্কের
কী-হোলে দুচার ফোটা
ঢেলে নিজে মনোজের হাত
থেকে চাবিটা নিয়ে আস্তে
দুবার ঘোরাতেই
ট্যাঙ্কের ঢাকনাটা
খুলে গেল। এবার তেলের
পটটা রেখে নজলটা
ট্যাঙ্কের মুখে ঢুকিয়ে
দুশো টাকার পেট্রল ভরে
হাত বাড়িয়ে টাকাটা
নিয়ে রেখে দেয় কাঁধে
আড়াআড়ি ঝোলানো
চামড়ার
স্লিংব্যাগটায়। অমল
আবার তাকালো মেয়েটির
দিকে। মেয়েটিও।
মেয়েটির চোখের দিকে
তাকিয়ে অমল
নিয়ন্ত্রণহীন বলে ওঠে
'নয়নতারা'। মেয়েটি কী
বুঝলো অমল জানে না, মৃদু
হেসে অমলকে বলল, নো
আঙ্কল। মাই নেম ইজ
আইবল্। আইবল ডি'সুজা।
শুনে রোমাঞ্চিত অমলের
বিস্মিত মুখে মেয়েটার
দিকে তাকানো, মনোজের
বাইক স্টার্ট দিয়ে
গিয়ার চেঞ্জ করে ডান
হাতে এক্সিলেটরে মোচড়
দেওয়া এবং অমলের
প্যান্টের পকেটে
মোবাইলটার হঠাৎ বেজে
ওঠা একই মুহূর্তে ঘটে
গেল। পকেট থেকে মোবাইল
বের করতে করতে চলন্ত
বাইক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে
অমল দেখতে পেল আইবল ডান
হাতে নজল ধরে এক
কাস্টমারের বাইকে
পেট্রল ভরতে ভরতে অমলের
দিকে তাকিয়ে বাঁহাতের
তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে
নিজের চোখের মণির দিকে
ইঙ্গিত করছে। বাইক
মুহূর্তে পেট্রলপাম্প
থেকে বেরিয়ে আবার চওড়া
রাস্তায় পড়ে স্পীড
বাড়ালে আড়ালে চলে
গেলো আইবল। মোবাইলটা
চোখের সামনে এনে অমল
দেখে কণার ফোন।
-- হ্যালো, ফোন ধরতে এত
দেরী করলে যে? কোথায়?
কণার অধৈর্য স্বর।
--- এয়ারপোর্ট যাচ্ছি।
কোলিগের বাইকে।
পেট্রলপাম্পে ছিলাম
তাই।
--- কাজু কিনেছো, না ভুলে
গেছ?
--- নয়নতারা।
--- কী? কী বলছ?
---- কণা, নয়নতারাকে মনে
আছে?
---- নয়নতারাটা আবার কে?
---- কলেজে আমাদের সঙ্গে
পড়তো, বায়ো নিয়ে,
ফার্স্টইয়ারে পড়তে
পড়তেই বিয়ে হয়েছিল...
---- হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে
আছে। কেন, তোমার মনে নেই,
বিয়ের তেরো দিনের মাথায়
হনিমুনে গিয়ে গোয়াতে
সমুদ্রে ডুবে মারা
গিয়েছিল? অবশ্য পরে
শুনেছিলাম দেনাপাওনার
ব্যাপারে বরই নাকি
বোগমালো না কোনো একটা
নির্জন বীচে জলে ডুবিয়ে
মেরে ফেলেছিল... কিন্তু
হঠাৎ তার কথা কেন?
অমল কোনো উত্তর দেওয়ার
আগেই ওর ফোনের সিগনাল
চলে গেলো।
'স্যার, এখন বাঁ দিকে
স্রিফ তিন কিলোমিটার
গেলেই বোগমালো বীচ।
চলুন আপনাকে একবার
ঘুরিয়ে নিয়ে যাই। সবে
তো এগারোটা। হাতে এখনো
অনেক টাইম।' মনোজ
হিন্দিতে বলে।
অমল মনোজের দুকাঁধে হাত
রেখে বলে, নেহি, সিধা
এয়ারপোর্ট চলিয়ে।
ফেসবুক মন্তব্য