(নাটকের মহড়া-কক্ষ ।
নাটকের মহড়া চলছে ।
বেঞ্চের উপর মৈনাক ও
সন্ধ্যাদীপা । মৈনাকের
হাতে একটা চিঠি,
চিন্তিত মুখে পড়ছে।
সন্ধ্যাদীপার মুখ
শ্রাবণের আকাশের মত
গম্ভীর )
মৈনাক ।। সর্বনাশ !
ভয়ংকর !! কী হবে ?
আত্মহত্যা ? না, না, তা
কেন ?এটা কী হ’ল? কেন
এমন…?
সন্ধ্যাদীপা ।। সাত
মাসে তুমি আমাকে তিনবার
ঠকিয়েছ । আর নয় । আজ সব
লিখে এনেছি ।
মৈনাক ।। আমি তোমাকে
ঠকিয়েছি, শ্রীতমা ? কী যা
তা বলছ , তুমি ?
সন্ধ্যাদীপা ।। হ্যাঁ,
তুমি...তুমি...প্রীতম !
মৈনাক ।। কি রকম?
সন্ধ্যাদীপা ।। আমি
আলুকাবলি খেতে
চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে
আলুকাবলি খাওয়াবে বলে
নাচিয়ে পার্কে এনে
কুলের আচার খাইয়েছিলে
। অস্বীকার করতে পারো ?
মৈনাক ।। কী করব পার্কে
সেদিন একটাও
আলুকাবলিঅলা আসেনি
যে...
সন্ধ্যাদীপা।। সে আমি
শুনতে চাইনা । সেটা কি
আমাকে ঠকান নয়? তারপর
আমার মাসিকে বললে তুমি
নাকি দার্জিলিং যাবে ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত
গেলে আঠারমুড়া ।
অস্বীকার করতে পারো ?
মৈনাক ।। না, অস্বীকার
করব না । প্লেনের টিকিট
পাইনি । তারপর ?
সন্ধ্যাদীপা ।। তুমি
জানতে । তুমি ঠিকই
জানতে ।
মৈনাক ।। কি জানতাম ?
সন্ধ্যাদীপা ।। তুমি
জানতে আমি জল ভয় পাই ?
মৈনাক ।। জানতাম । তো ?
সন্ধ্যাদীপা ।। লেকের
ধারে নিয়ে এসে দুপুর
বেলায়, কেউ ছিল না, আমাকে
নিয়ে লেকের জলে পড়ে
গেলে...
মৈনাক ।। আরে ওটা
রোম্যান্টিক । বোঝোনা
কেন?
সন্ধ্যাদীপা ।।
রোম্যান্টিক ? আমি কচি
খুকি ? আমার চুল ভিজলে
তিনদিনেও শুকোয় না ।
তোমার কোন ধারণা আছে?
মৈনাক ।। না, নেই ।
কিন্তু এগুলো তোমাকে
ঠকান হ’ল ?
সন্ধ্যাদীপা ।।
নিশ্চয়ই ঠকানো ! আলবৎ
ঠকানো ! কুলের আচার খেয়ে
আমার জ্বর হয় । তুমি
দার্জিলিং যাবে শুনে
আমি পনেরো মিনিট
কেঁদেছিলাম ।
উগ্রপন্থীরা তোমাকে
গুলি করে উড়িয়ে দেবে এই
ভয়ে । লেকের জলে পড়ে
গিয়ে আমার ঠাণ্ডা লাগে,
কাশি হয় । এর পরেও,
ঠকানো নয় ?
মৈনাক ।। হে হে হে, হে হে
হে
সন্ধ্যাদীপা ।।
নির্লজ্জ্ব ! তুমি হাসছ?
কেন? হাসবে কেন তুমি ?
কেন ?
মৈনাক ।। তা হলে কি
কাঁদবো ? অবশ্য কাঁদার
কারণও আছে ।
সন্ধ্যাদীপা ।। কি
রকম?
মৈনাক ।। আমি মরে যাবো
এই দুশ্চিন্তায় তুমি
এতো দুঃখ পেলে ?
সন্ধ্যাদীপা ।। কেন নয়,
প্রীতম ? আমি যে তোমার
হীরামন । আমি যে তোমায়
ভালোবাসি ।
মৈনাক ।। মাত্র পনেরো
মিনিটের কান্নাতেই
চোখের জল শুকিয়ে গেলো ?
সন্ধ্যাদীপা ।। (রাগত
স্বরে ) তো, তুমি কী আশা
করেছিলে? আমি অশোকবনে
সীতার মতো তোমার জন্যে
কেঁদে ভাসাবো নাকি ?
আমার যা বলবার, আমি আজ সব
লিখে এনেছি । পড়ো ,
প্রীতম। আমি
আত্মহত্যার পথই বেছে
নিলাম ।
মৈনাক ।। কিন্তু, লিখে
আনার কী ছিল ? এর আগে
পাঁচ- ছয় বার আত্মহত্যা
করতে যাবার আগে তো তুমি
আমাকে মুখেই বলেছিলে,
শ্রীতমা ?
সন্ধ্যাদীপা ।।মুখে
বলেছিলাম বলেই বোধ
হয়,শেষ পর্যন্ত
আত্মহত্যা করতে পারিনি
। তাই এবার লিখেই
এনেছি। (ফুঁপিয়ে কান্না
)
মৈনাক ।। আচ্ছা, একটা
কথা বলবো ?
সন্ধ্যাদীপা ।। (কান্না
সামলে, রুমালে চোখ মুছে )
বলো, শুনছি ।
মৈনাক ।। দেখো, লোকে
আত্মহত্যা করে জীবনে
চরম অপমানিত হলে ।
সন্ধ্যাদীপা ।।
(ঝাঁঝিয়ে ঊঠে ) আমার চরম
অপমানের আর বাকী কী আছে
?
মৈনাক ।। কেন-ও?
সন্ধ্যাদীপা ।।
বুবলাকে চেন তুমি ?
তোমাদের পাড়ার বুবলাকে
?
মৈনাক ।। না চিনবো কেন ?
এল আই সি-র এজেণ্ট ।
সন্ধ্যাদীপা ।। আরে, ঐ
বুবলা নয় । যে জলের কল
সারায় ।
মৈনাক ।। যাঃ, ওর নাম তো
বিনয় ।
সন্ধ্যাদীপা ।। সে যাই
হোক, ঐ জলের কল সারানো
ছেলেটা তিনদিন ধরে
আমাকে ফলো করছে ।
মৈনাক ।। সেটা তোমার
মনের ভুলও হ’তে পারে ।
সন্ধ্যাদীপা ।। আর আমার
দিকে তাকিয়ে সে যে হাঁ
করে দেখে, সেটা ?
মৈনাক ।। সেটাও তোমার
মনের ভুল হ’তে পারে ।
সন্ধ্যাদীপা ।। আমি
বাস-স্ট্যান্ডে বাস
থেকে নামছিলাম । ওই
লোকটা এগিয়ে এসে আমাকে
হাত ধ’রে নামাতে
গেসলো।
মৈনাক ।। অ্যাঁ ?
সন্ধ্যাদীপা ।। হ্যাঁ।
আরো শুনে রাখো, কাল যখন
কলেজে যাচ্ছিলাম সে
আমার সেলফোনে মেসেজ
পাঠিয়েছে ।
মৈনাক ।। কী? মেসেজ ? কী
মেসেজ ?
সন্ধ্যাদীপা ।। লিখেছে
– ‘আমি তোমাকে চাই । ইতি-
জলের কলের মিস্ত্রি’।
সেই থেকেই আমার মরে
যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ।
মৈনাক ।। (প্রচণ্ড রেগে
গিয়ে ) আমি ওকে মারবো ।
খুব মারবো । এক রদ্দা
মেরে ওর চোয়ালের হাড়
ভেঙে দেবো ।
সন্ধ্যাদীপা ।। পারবে ?
তোমার ব্যথা লাগবে না ?
(দুজনেই খুব বিরক্ত
হ’য়ে মঞ্চের সামনের
দিকে এগিয়ে আসে)
মৈনাক ।। দূর, দূর – এটা
একটা নাটক ? এইগুলো
ডায়ালগ ?
সন্ধ্যাদীপা ।। (মুখ
ভেঙিয়ে ) ‘পারবে ? তোমার
ব্যথা লাগবে না?’ কী
আনস্মার্ট ডায়ালগ !
মৈনাক ।। এই নাটক কখনো
চলতে পারে না ।
সন্ধ্যাদীপা ।। দর্শক
নেবেই না । যেখানে
প্রতিদিন সিনেমা
সিরিয়ালে নায়ক ঝাড়পিট
করছে, নায়িকা ক্ল্যাপ
মেরে নায়ককে
ফাটাফাটিতে উৎসাহ
দিচ্ছে, নায়কের ঠোঁট
নাক কেটে রক্ত গড়িয়ে
পড়ছে, সেখানে এই ডায়ালগ?
(মুখ ভেঙিয়ে ) ‘পারবে ?
তোমার ব্যথা লাগবে না?’
অবাস্তব সংলাপ !
মৈনাক ।। তবে, তুই
কিন্তু সেদিন পার্কের
বেঞ্চিতে বসে আমাকে এই
ডায়ালগই মেরেছিলি,
সন্ধ্যাদীপা ।
সন্ধ্যাদীপা ।। কি রকম?
কি রকম?
মৈনাক ।। মনে আছে পাঁচ
পাঁচ বার তোর ফেইস বুক
অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে
যায় । কে বা কারা যেন তোর
পাশোয়ার্ড বের করে
নিয়ে তোর অ্যাকাউন্ট
খুলে আমাদের মেসেজগুলো
সব পড়ে ফেলে । তখন তুইও
পার্কের বেঞ্চিতে বসে
আমাকে বলেছিলি
আত্মহত্যা করবি ।
সন্ধ্যাদীপা ।। আরে,
সেটা তো বাস্তব জীবন ।
সেখানে যেটা বলা চলে,
সেটা কি আর নাটকে চলতে
পারে?
মৈনাক ।। তা হলে এই
নাটকের ডায়ালগগুলোকে
অবাস্তব সংলাপ বলছিস
কেন ? বাস্তব জীবনেই যখন
এমন ঘটছে, বাস্তব
জীবনেই যখন আমরা এরকম
কথা আখছার বলছি ?
সন্ধ্যাদীপা ।। সে আমি
জানি না । আমি জানি এ
নাটক চলবে না ।
মৈনাক ।। সে কথায় আমিও
একমত । চল, নাট্যকারকেই
গিয়ে ধরি । স্ক্রিপ্ট
পালটে লিখতে বলি ।
সন্ধ্যাদীপা ।। হ্যাঁ,
ঠিক । চল আলেখদাকেই
গিয়ে বলি ।
মৈনাক ।। আলেখদা-আ-আ-আ...
শ্রীমান
না-ট-টো---ও—কা—আ—আ—র…
সন্ধ্যাদীপা ।।
শ্রীমান
না-ট-টো---ও—কা—আ—আ—র…
( দুজনেই চলে যায় )
( আলেখ ও আন্দোলনের
প্রবেশ । আলেখের পরনে
প্যান্ট শার্ট, চোখে
পুরু লেন্সের চশমা ।
এলোমেলো চুল, দাড়ি ।
আন্দোলনের পরনে ফরসা
পাটভাঙ্গা পাজামা
পাঞ্জাবি, কাঁচা-পাকা
চুল, জুলফি। পরিপাটি
করে দাড়ি কামানো,কাঁধে
সাইড ব্যাগ । )
আন্দোলন ।।(গম্ভীর
ভাবে) তুমি আমাকে যে
তোমার নাটকের প্রথম
অঙ্কের স্ক্রিপ্টটা
পড়তে দিয়েছিলে সেটা আমি
পড়লাম ।
আলেখ ।। ও, হ্যাঁ, ওই
যেখানে দুটি ছেলেমেয়ে
কথা বলছে পার্কে বসে,
মেয়েটি বলছে আত্মহত্যা
করবে...ঐ মেয়েটিই
সেন্টার।নাটকটার নাম
দিয়েছি ‘আত্মহনন’ ।
নামটা কেমন লাগছে,
আন্দোলনদা?
আন্দোলন ।। (আরও গম্ভীর
ভাবে) হ্যাঁ ওইটার কথাই
বলছি । নামটা তো ভালই,
তবে কিছু মনে কর না...
আলেখ ।। না, না, মনে করার
কি আছে ? আপনার যেমন
লেগেছে আপনি তো তেমনই
বলবেন । বলুন ।
আন্দোলন ।। হ্যাঁ, বলছি
। (একটু থেমে, কেশে)এটা
কিন্তু ভাই কিছুই হয়নি
। কোনও মেসেজই নেই ওর
মধ্যে । অত্যন্ত
অবাস্তব সংলাপ। এরকম
নাটক যে মানুষের কোন্
কাজে লাগবে, তা কে জানে
?
আলেখ ।। আচ্ছা
আন্দোলনদা, কোনও কাজেই
লাগবে না, আপনি সিওর ?
আন্দোলন ।। কোন্ কাজে
লাগবে ভাই? মানুষের
জীবনের জটিল কোন
সমস্যার কথা আছে এখানে
?
আলেখ ।। না, নেই ।
আন্দোলন ।। দেশময় এতো
দারিদ্র্য, নির্যাতিত,
নিপীড়িত মানুষের উপর
এতো শোষণ, এসব কথা আছে এই
নাটকে?
আলেখ ।। না, তাও নেই ।
আন্দোলন ।। মানুষের
সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ,
জনসংগ্রাম, রক্তক্ষয়ী
বিপ্লবের ইতিহাস এবং
সময়ের মানদণ্ডে তার
নির্মম বিশ্লেষণ,
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ,
আছে কিছু ?
আলেখ ।। উঁহু । নেই ।
আন্দোলন ।।
বিচ্ছিন্নতাবাদ,
উগ্রপন্থা, সঙ্কীর্ণ
প্রাদেশিকতা,
সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ...?
আলেখ ।। নেই ।
আন্দোলন ।। ধর্মীয় কোনও
কাহিনী----বিশ্লেষণ
অবশ্য করতে হবে আমাদের
আজকের সময়কে মাথায়
রেখে...তা সে রকম কিছু...?
আলেখ ।। (হতাশ ভাবে
দুপাশে মাথা নেড়ে) নেই,
আন্দোলনদা, নেই ।
আন্দোলন ।। নারী মুক্তি
আন্দোলন নিয়ে তো কিছু
বলতে পারতে ! আছে নাকি
এরকম কিছু তোমার নাটকে
?
আলেখ ।। নাঃ ।
আন্দোলন ।। তাইত বলছি
আলেখ, কোনও মেসেজই নেই ।
এরকম নাটক মানুষের
কোন্ কাজে লাগবে?
আলেখ ।। কেন
এন্টারটেইনমেন্ট ? সেটা
কি কোন কাজে লাগা নয়?
আন্দোলন ।।
এন্টারটেইনমেন্ট ?
(ছদ্ম বিস্ময়ে) তোমার
নাটকে কি অইসব সিরিয়াল
মার্কা , ঢপের চপ বলিউডি
নাচাগানা, ঝাড়পিট,
সস্তা ডায়ালগ লাগাবে না
কি ? তুমি এতো নীচে নেমে
যেতে পারলে?
আলেখ ।। ( হঠাৎ উত্তেজিত
ভাবে) মোটেই না ।
এন্টারটেইনমেন্ট
জিনিসটাকে এতো স্থূল
ভাবে দেখা ঠিক নয় । আর
শিল্পকলায় যদি
এন্টারটেইনমেন্ট
জিনিসটাই না থাকলো, তা
হলে আর কি হল? শিল্পকলা
তো আর ইস্তাহার নয় ।
আমার নাটকে অন্য জাতের
এন্টারটেইনমেন্ট আছে
।
আন্দোলন ।। হুমম । আর ওই
অবাস্তব ডায়ালগ ?
আলেখ ।। অবাস্তব নয় ।
আন্দোলন ।। অবাস্তব
নয়?
আলেখ ।। না । আচ্ছা,
আন্দোলনদা, একটা মেয়ে
আর একটা ছেলে, যারা
প্রেমে পড়েছে, পার্কে
বসে গল্প করছে, বলুন তো
তারা তাদের আলোচনায় কি
দারিদ্র্য, শোষণ এসব
নিয়ে কথা বলে ?
আন্দোলন ।। বলে না হয়তো
। কিন্তু বলা উচিত ।
আলেখ ।। তারা এসব নিয়ে
কথা বলে, কি বলে না? কি
উচিত, কি অনুচিত, সে কথা
হচ্ছে না । বাস্তবে
তারা এসব নিয়ে কথা বলে ?
আন্দোলন ।।তা বলে না ।
(বিরক্ত হয়ে ) তা আমি কি
করে জানবো ?
আলেখ ।। কিছু মনে করবেন
না । আপনার যখন কলেজ
লাইফে পার্টি করতে গিয়ে
সঞ্চারীদির সঙ্গে আলাপ
হোল, তাঁর সঙ্গে চায়ের
দোকানে ব’সে আড্ডা
দিতেন, তখন একান্ত
মুহূর্তে আপনারা
মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ
প্রতিবাদ, জনসংগ্রাম,
রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের
ইতিহাস এবং সময়ের
মানদণ্ডে তার নির্মম
বিশ্লেষণ, দ্বান্দ্বিক
বস্তুবাদ –এসব নিয়ে
আলোচনা করতেন?
আন্দোলন ।।তুমি তো ভারি
পাকা ছেলে । (হেসে ফেলে)
সে যা করতাম করতাম । তবে
আজকের দিনের ছেলেরা ,
তোমাদের জেনারেশনের
ছেলেমেয়েরা নিজেদের
মধ্যে ... নাঃ, তা ক’রে না
বোধ হয় আলোচনা এসব ।
‘আমাকে আমার মতো থাকতে
দাও’ এই তো সব তোমাদের
গান ! হিঃ ।
আলেখ ।।
বিচ্ছিন্নতাবাদ,
উগ্রপন্থা, সঙ্কীর্ণ
প্রাদেশিকতা,
সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ...
আপনার কি মনে হয়, এসব
নিয়ে আমাদের
জেনারেশনের
ছেলেমেয়েরা পার্কে বসে
কথা বলে ?
আন্দোলন ।।না, তাও মনে
হয় না, ভাই ।
আলেখ ।। ধর্মীয় কিছু
নিয়ে ?
আন্দোলন ।। আরে, না,না,
সে প্রশ্নই ওঠে না ।
আলেখ ।। নারী মুক্তি
আন্দোলন নিয়ে ?
আন্দোলন ।। মেয়েরা রেগে
থাকলে অনেক সময় বলে
হয়তো ...
আলেখ ।। অন্য আর কোন রকম
মেসেজ নিয়ে কথা বলে
তারা পার্কের বেঞ্চে
বসে?
আন্দোলন ।। সাধারণত বলে
না বলেই মনে হয় ।
আলেখ ।। সাধারণত মানুষ
যা বলে সেটাই তো বাস্তব
। নয় ?
আন্দোলন ।। হুমম । বলে
যাও...
আলেখ ।। তা হলে নাটকে
মেসেজঅলা ডায়ালগ বসালে
সেটা অবাস্তব সংলাপ হবে
। তাই না?আমার নাটকে
অবশ্য মেসেজ কিছু আছেই,
তবে প্রনাউন্সড নয় । আর
একটা কথা শুনবেন ?
আন্দোলন ।।বল ।
আলেখ ।। আপনি যেকোনো
পার্কে বেঞ্চগুলোর
নিচে ভয়েস রেকর্ডার
রেখে দিন। শুনবেন, ওরা
আমার এই নাটকের ভাষাতেই
কথা বলছে । কোনো
সীরিয়াস বাৎচিত নয় । তা
হলে , আমার সংলাপ কি করে
অবাস্তব হল ? শুনুন, আমি
বলি কি, আজকে আমার
আরেকটা নাটকের
স্টেজ-রিহার্সাল
আছে—‘যুগাবর্ত’ । আপনি
একটু দেখেই যান না ।
আন্দোলন ।। বলছো ? আমার
আবার একটা মীটিং ছিলো
আটটা থেকে। আচ্ছা
,আধঘণ্টা হতে পারে। দেখ
বোর করবে না তো ?
আলেখ ।। আশা করি, বোর
হবেন না, (হেসে ) আসুন, আজ
আমাদের ড্রেস
রিহার্সাল আছে । চলুন ।
মানুষের ইতিহাসটা যে
একটা জগাখিচুড়ি
কন্ট্রাডিকশনে
ভরা--সেটাই দেখাবো
আপনাকে ।
আন্দোলন ।। চলো ।
(দুজনে বেরিয়ে যায় )
(আলো নিভে যাবে )
(আলো জ্বলে উঠলে দেখা
যাবে প্রেক্ষাপট
পাল্টে গেছে । নাটকের
মহড়া-কক্ষ । বৃক্ষতলে
বেদীর উপর তথাগত
বুদ্ধ। নীচে বসে আছেন,
একদিকে আনন্দ, কোশলরাজ
প্রসেনজিত; অন্যদিকে
মিগারমাতা যুবতী
বিশাখা, একজন শ্রেষ্ঠী
ও কোশলরাজ্যের সেনাপতি
। এই পাঁচ জনের
প্রত্যেকের হাতেই
প্রণামের মুদ্রা, শুধু
বিশাখার হাতে একটি
মুদিত কমলকলিকা)
উপবিষ্ট পাঁচ ভক্ত ।।
অভিবাদন । তথাগতর
চরণকমলে অভিবাদন ।
বুদ্ধ ।। স্বাগত ।
অনাথপিন্ডকের এই
সঙ্ঘারামে স্বাগত হে
উপাসক, উপাসিকা । এসো,
দেখো, নিজের অন্তরের
প্রদীপ্তিকে
সমুজ্জ্বল করে তোল ।
নিজেই হও নিজের প্রদীপ
। এই দুঃখ পরিপূর্ণ
সংসার-চক্র থেকে নির্গত
হবার পন্থা অনুসরণ কর ।
প্রযত্ন কর । নির্বাণের
পরমা শান্তি অনুভব কর
।
আনন্দ ।। ভগবন, বহুবার
শ্রুত হলেও, আমরা আবার
আপনার নিকট হতে এই
দুঃখময় সংসারের কারণ
জানতে চাই ।
বুদ্ধ ।।আনন্দ, দুঃখময়
সংসারের কারণ বাসনা।
বাসনাপ্রভাবেই আমরা এই
জরা-ব্যধি সংকুল
যন্ত্রণাময় জগত অবলোকন
করি ।
আনন্দ ।। কিন্তু ভগবন,
এই বাসনার কারণই বা কি ?
বুদ্ধ ।। বাসনার কারণ
অবিদ্যাজনিত অহঙ্কার ।
অবিদ্যাবশতই জীব নিজের
সীমিত অস্তিত্বকে সত্য
বলে ভুল করে । কিন্তু,
সীমিত এই অস্তিত্ব কি
সত্যই সারবান ? বাস্তব ?
প্রতিটি জীবের
অস্তিত্ব তো শুধু রূপ,
বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা
ও সংস্কারের সমষ্টি
মাত্র । এগুলি একত্রিত
হলে আমাদের সীমিত
অস্তিত্বের ভ্রান্তি
হয় । এগুলি পরস্পরের
থেকে পৃথক হয়ে গেলে ওই
সীমিত অস্তিত্বের নাশ
হয় । তা হলে এই সীমিত
অস্তিত্ব, এই দেহ,এই
মনকে চিরস্থায়ী ভেবে
বারংবার দুঃখমুখে পতিত
হয়ে হা-হা স্বরে বিলাপ
করার কি প্রয়োজন?
প্রসেনজিত ।। ভগবন,
আমাদের এই অবিদ্যাজনিত
অহঙ্কার আমাদের কিভাবে
দুঃখ দিয়ে থাকে ?
বুদ্ধ ।। নিজেকেই এই
প্রশ্ন করুন না, মহারাজ !
(ঈষৎ হেসে) এই অহঙ্কারের
ফলেই তো আপনি বারবার
আপনার রাজ্যের
সীমানাতে সন্তুষ্ট না
থেকে পররাজ্য আক্রমণে
ব্রতী হয়েছেন । এই
অহঙ্কারের ফলেই কতো
যুদ্ধ,কতো রক্তপাত, কতো
ঘৃণ্য চক্রান্ত, কতো
গুপ্ত হত্যা, এই
যন্ত্রণাময় পৃথিবীতে
আরও কতো নতুন যন্ত্রণার
উদ্ভব! এই অহঙ্কারের
কারণেই আপনার মন
শান্তিহীন, এই
অহঙ্কারের কারণেই
আপনার উৎকণ্ঠিত
বিনিদ্র রাত্রি যাপন !
সেনাপতি ।। (ব্যাকুল
স্বরে )তা হোলে এই
অবস্থা থেকে মুক্তির কি
উপায়, ভগবন?
বুদ্ধ ।। উপায়
সর্বকল্যাণপ্রদ
অহিংসা ও সর্বজীবের
প্রতি মৈত্রী । উত্থিত,
উপবিষ্ট, শায়িত,
দণ্ডায়মান, ধাবমান –সব
অবস্থাতে সকল জীবের
প্রতি বন্ধুত্বের,
প্রীতির ও সহমর্মিতার
ভাব বজায় রাখা;
কায়-মনো-বাক্যে কাউকে
হিংসা না করা, কাউকে
আঘাত না করা । এ ভাবেই
একমাত্র অহমিকার হাত
থেকে মুক্তি হতে পারে, এ
ভাবেই সকল দুঃখের হাত
থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে
পারে, নির্বাণ লাভ হতে
পারে, সম্যক সম্বোধিলাভ
সম্ভব হতে পারে ।
সেনাপতি ।। (উঠে
বুদ্ধের পায়ে মাথা রেখে
নতজানু হয়ে বসেন)ভগবন
তথাগত, আমাকে আপনার
চরণে স্থান দিন ।
বুদ্ধ ।। কি চাও তুমি,
যুবক ?
সেনাপতি ।। প্রব্রজ্যা,
ভগবন, আমাকে প্রব্রজ্যা
দান করে নির্বাণমার্গে
পরিচালিত করুন ।
বুদ্ধ ।। এসো যুবক, এই
সন্ন্যাসমার্গে
প্রবেশ কর । শীল, সমাধি,
প্রজ্ঞার অনুশীলন কর ।
নির্বাণ লাভ কর ।
আনন্দ—
( আনন্দকে ইঙ্গিত করেন ।
আনন্দ ও সেনাপতি উঠে
দাঁড়ান । সেনাপতি
তরবারি,
শিরস্ত্রান,বর্ম , হস্ত
ও কর্ণভূষণ খুলে
বুদ্ধের চরণে সমর্পণ
করেন । আনন্দ সেনাপতির
অবশিষ্ট পরিধানের উপর
গৈরিক কাষায় পরিয়ে দেন
ও সেনাপতির হাতে একটি
ভিক্ষাপাত্র স্থাপন
করেন । )
সেনাপতি ।। বুদ্ধং শরণং
গচ্ছামি, ধম্মং শরণং
গচ্ছামি,সঙ্ঘং শরণং
গচ্ছামি...
( বুদ্ধ ছাড়া সবাই উঠে
দাঁড়ান ও ‘বুদ্ধং শরণং
গচ্ছামি, ধম্মং শরণং
গচ্ছামি,সঙ্ঘং শরণং
গচ্ছামি...’ উচ্চারণ
ক’রে বুদ্ধের
পাদবন্দনা ক’রে
সেনাপতিকে অভিবাদন
করেন এবং নিজ নিজ
স্থানে এসে বসেন।
কোশলরাজ প্রসেনজিতের
মুখ চিন্তিত দেখাবে।
সেনাপতি বুদ্ধকে
প্রণাম জানিয়ে ‘বুদ্ধং
শরণং গচ্ছামি, ধম্মং
শরণং গচ্ছামি,সঙ্ঘং
শরণং গচ্ছামি...’
উচ্চারণ করতে করতে মঞ্চ
থেকে বেরিয়ে যাবেন।)
শ্রেষ্ঠী ।। ভগবান
তথাগতর চরণে নমস্কার ।
ধন্য এই যুবক সেনাপতি,
এতো অল্প বয়সে
সন্ন্যাসমার্গে বৃত
হলেন । কিন্তু, ভদন্ত,
আমার একটি জিজ্ঞাস্য
আছে ।
বুদ্ধ ।। বলো শ্রেষ্ঠী,
কি তোমার জিজ্ঞাস্য ।
শ্রেষ্ঠী ।। এই অল্প
বয়সে সন্ন্যাসমার্গে
বৃত যুবক সেনাপতিকে
দেখে আমি অনুপ্রেরণা
বোধ করলাম । কিন্তু
ভদন্ত, আমার মন এখনো
এতদূর তৈরী হয় নি । আমি
এখনো জগতের সুখ কাঙ্খা
করি ।
বুদ্ধ ।। জাগতিক সুখে
শান্তি নেই শ্রেষ্ঠী ।
পরিণামে শুধু দুঃখ ।
প্রব্রজ্যাতেই শান্তি,
নির্বাণেই আনন্দ ।
শ্রেষ্ঠী ।। কিন্তু
জগতে কি কিছুমাত্রও সুখ
নেই ? যখন এখানে আসি,
তথাগতকে দর্শন করি মনে
হয়, সত্যই জগতের সুখ
তুচ্ছ, নির্বাণপদবীর
জন্য মন তৃষিত হয়ে ওঠে ।
কিন্তু, যখন এখান থেকে
চলে যাই, সার্থবাহ নিয়ে
দেশে দেশে যাই,
অর্ণবপোত নিয়ে
বানিজ্যে বেরিয়ে পড়ি,
সুমাত্রা, যবদ্বীপ,
সূ্র্পারক, মালয়... তখন
এসব ত্যাগ বৈরাগ্যের
কথা কোথায় উবে যায়...
অর্থ, নারী আর সুরার
সমুদ্রে আন্দোলিত হতে
থাকি... আচ্ছা ভদন্ত,
আমার অপরাধ মার্জনা
করবেন, আপনার
চিন্তাধারায় আমার মতো
মানুষের জন্যে এই
বাস্তব জগতটাকে একটু
লেহন, চর্বণ করে ভোগ
করার কোন উপায় কি নেই?
বুদ্ধ ।। না, শ্রেষ্ঠী ।
জগত দুঃখময় । একে ভোগ
করার অর্থই পরিণামে
দুঃখকে বরণ করা ।
শ্রেষ্ঠী ।। তবে এখনো
আমার সময় হয় নি । (উঠে
তথাগতকে বন্দনা করে)
বুদ্ধ ।। বেশ । যখন সময়
হবে তখন অনাথপিন্ডকের
এই সঙ্ঘারাম তোমার জন্য
উন্মুক্ত থাকবে । তবে
একটা কথা মনে রেখো, সময়
তোমার প্রযত্নের উপর
নির্ভর করে । আর মনে
রেখো, আয়ু সীমিত, জীবন
ক্ষণিক । তবে তুমি এসো,
শ্রেষ্ঠী ।
(শ্রেষ্ঠী বেরিয়ে
যায় ।)
বিশাখা ।। ভগবান তথাগতর
নিকট আমারও একটি প্রশ্ন
আছে । জিজ্ঞাসা করার
অধিকার দিন, দেব ।
বুদ্ধ ।। বলো মিগারমাতা
বিশাখা, তুমি তথাগতর
অগ্রশ্রাবিকা,
জিজ্ঞাসা করার পূর্ণ
অধিকার তোমার আছে ।
বিশাখা ।। সদ্য
প্রব্রজ্যাপ্রাপ্ত
রাজসেনাপতির মতো
উচ্চাধিকার আমার নেই ।
আমি এক সাধারণ নারী।
বুদ্ধ ।। তুমি সাধারণী
নও , কন্যা । তুমি
বিদুষী, বাল্যে তুমি
পিতৃগৃহে তোমার
ঐন্দ্রজালিক পিতার কাছ
হ’তে শুধু ভোজবিদ্যার
শিক্ষাই নাওনি, রীতিমত
মল্লবিদ্যাও শিক্ষা
করেছো । তা ছাড়া
শাস্ত্রশিক্ষার
পাশাপাশি তুমি সেবা,
দান , সৌজন্য, শীল সব
চরিত্রশিক্ষাই পেয়েছ ।
তোমার দানে এই সঙ্ঘ
বহুভাবে উপকৃত হয়েছে ।
থাক, সে সব কথা । বলো, কি
প্রশ্ন আছে তোমার ?
বিশাখা ।। কিছু আগে
আপনি যে অহিংসা ও
মৈত্রীর আদর্শ
ব্যাখ্যা করলেন, তা
অনুপম । কিন্তু, ভগবন...
বুদ্ধ ।। কিন্তু কি,
কন্যা ?
বিশাখা ।। সংসার আশ্রমে
বাস্তব জীবনে এই অহিংস
নীতি কি ভাবে পালন করা
সম্ভব?
বুদ্ধ ।। কেন কন্যা ?
অসম্ভব কিসে?
বিশাখা ।। ভগবন, অধীনার
অপরাধ মার্জনা করবেন ।
কৈশোর উত্তীর্ণ হতেই
আমাকে বিবাহ দেওয়া হল ।
বিবাহের সাড়ম্বর
অনুষ্ঠান সমাপ্ত হবার
পরে পরেই আমি আবিষ্কার
করলাম, আমার স্বামী
অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল । সে
প্রতি সন্ধ্যা
বারাঙ্গনা গৃহে
অতিবাহন করে । সে মদ্যপ
। তবু, আমি তার
স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
করিনি । কিন্তু যে দিন
সে মধ্যরাত্রে
বারাঙ্গনালয় ও
শৌন্ড্রিকাগার হতে
সম্পূর্ণ মদ্যপ হয়ে
ফিরে আসঙ্গলিপ্সায়
আমাকে প্রার্থনা করল,
সেদিন আমি আর সহ্য করতে
পারিনি। আমি তাকে বাধা
দেওয়া সত্ত্বেও সে
নিবৃত্ত হল না, সে
বলপ্রয়োগ করতে এলে,আমি
তার মনিবন্ধ আমার
বামহস্তে ধারণ করে তাকে
শয্যা হতে দূরে সবলে
নিক্ষেপ করেছিলাম। এ
নিয়ে আমার স্বামী,
শ্বশ্রু ও
শ্বশ্রুমাতার সঙ্গে
আমার সাংসারিক অশান্তি
শুরু হল । আমার
উচ্ছৃঙ্খল স্বামীর
প্রতি আমার কি আচরণীয়
ছিল, ভগবন ? অহিংসা
পরমধর্ম পালন ক’রে
অত্যাচারিত হওয়া ? নাকি
তৎক্ষণাৎ কেশকলাপ
মুন্ডন ক’রে
প্রব্রজ্যা গ্রহন করা
?
বুদ্ধ ।। তোমার শৈশবের
মল্লবিদ্যার শিক্ষা
ব্যর্থ হয় নি, কন্যা ! (
স্নিগ্ধ মধুর হাস্য ) ।
কিন্তু তুমি তো প্রীতি
ও সেবার দ্বারা তোমার
স্বামীকে সুপথে নিয়ে
আসতে পারতে ?
বিশাখা ।। না ভগবন,
আপনার ন্যায় অসাধারণ
শক্তিমানের পক্ষে যা
বাস্তব, অন্যদের পক্ষে
তা নিতান্তই অবাস্তব ।
সেই কারণেই আপনার
পক্ষে যা আচরণীয়,
আমাদের ন্যায় সাধারণ
মানব-মানবীর পক্ষে তা
শুধু অকল্পনীয়ই নয়, সে
আচরণ আমাদের পক্ষে
সমূহ ক্ষতিকর,অবাস্তব
।
আনন্দ ।। মিগারমাতা !
বিশাখা ।। হ্যাঁ শ্রমণ
। পূর্ণ অহিংসার আদর্শ
আমাদের পক্ষে সমূহ
ক্ষতিকর । যদি কেউ এই
পূর্ণ অহিংসার আদর্শ
একদিনও আচরণ করে, তা
হ’লে দুর্বৃত্ত ,
অনাচারী ও অন্যায়কারী
মানুষে দেশ পূর্ণ হয়ে
যাবে । পুরুষ ও নারী
শক্তিশূন্য হয়ে পড়বে ।
অন্যায়ের প্রতিকারও
কেউ করবে না ।
প্রত্যেকেই নিজের
ভীরুতাকে অহিংসার
আলোকে ব্যাখ্যা ক’রবে
।
প্রসেনজিত ।। ভগবন,
মিগারমাতা বিশাখার
বিচার যুক্তিহীন নয় ।
আমারও মনে হয়, যে চরম
অহিংসা ও চরম ত্যাগের
আদর্শ ভগবান তথাগত
প্রচার করছেন, তা
রাজ্যনীতি পরিচালনার
বিশেষ অন্তরায় ।
বুদ্ধ ।। (তির্যক ভাবে )
সম্প্রতি আপনি কি সে
রকম কোনও বিশেষ অন্তরায়
অনুভব করছেন, হে
কোশলরাজ প্রসেনজিত ?
প্রসেনজিত ।। ভগবন
মর্মদর্শী । এ পর্যন্ত
আমার মোট বারোজন
যুদ্ধবিদ্যানিপুণ
সেনাপতি এবং গণনাতীত
সৈনিক-- তথাগতর
সর্বত্যাগের আদর্শে
আকৃষ্ট হয়ে সঙ্ঘে
ভিক্ষুরূপে প্রবেশ
করেছে । যাদের হস্তে
একদিন শোভা পেতো খর
তরবারি, গদা, তোমর ও খড়গ,
আজ তাদের হস্তে তথাগত
তুলে দিয়েছেন
ভিক্ষাপাত্র । তথাগতর
সর্বত্যাগের আদর্শে
আকৃষ্ট হয়ে শত শত শাক্য,
কোলিয়, মাগধী এবং
অন্যান্য উচ্চ
রাজবংশীয় ক্ষত্রিয়
যুবক সন্ন্যাসীর জীবন
গ্রহণ করেছে ।
আর্যাবর্ত যে সব
প্রতিভাবান যুবকদের
নিকট হতে সর্বাধিক
উপকৃত হ’ত, যাদের উপর
সমাজের সর্বাধিক
নির্ভরতা, যদি তারাই
দলে দলে সন্ন্যাসীসংঘে
প্রবেশ করে, তা হ’লে
সমাজ যে ক্ষয়রোগগ্রস্ত
হয়ে পড়বে, তাতে আর
সন্দেহ নাই ।
বুদ্ধ ।। কিন্তু কেউ
যদি বৈরাগ্য অবলম্বন
ক’রে প্রব্রজ্যা
গ্রহণে উৎসাহী হয়, আমি
তাদের প্রত্যাখ্যান
করি কি রূপে ? কোশলরাজ
প্রসেনজিত, আমি কি
আপনার স্কন্ধাবারের
সেনানীদের আমন্ত্রণ
পাঠিয়ে বলেছি, ওহে
সেনানিগণ, ওহে যুবকগণ,
এস সঙ্ঘে প্রবেশ কর?
বিশাখা ।। না, তা নয় ।
কিন্তু, গৃহস্থের
অনধিকার চর্চা ক্ষমনীয়,
ভদন্ত । এই সব
প্রব্রজ্যাকামী
যুবকগণ যে তথাগতর ধর্ম
ও দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে
সঙ্ঘে প্রবেশ করছে, তা
আমাদের মনে হয় না ।
তথাগতর ব্যক্তিত্বে
আকৃষ্ট হয়েই এই যুবকগণ
প্রব্রজ্যাকামী
হয়েছেন—এই আমার
বিশ্বাস । ফলত, তথাগতর
উপস্থিতিতে সঙ্ঘ হয়ে
ওঠে সর্বতোভদ্র , আর
তাঁর অনুপস্থিতিতে
সঙ্ঘে প্রবেশ করে
অনাচার । যখনই আপনি এ
স্থান থেকে অন্য কোনো
সংঘারামে দেশনায়
গিয়েছেন, তখনই এ বাস্তব
ঘটনার সাক্ষী আমাদের
বারংবার হতে হয়েছে ।
বুদ্ধ ।। কিন্তু
বিশাখা, আমি কি বারংবার
আমার উপর নির্ভর না
ক’রে, আমার শিক্ষার উপর
নির্ভর করতে বলি নি?
সর্বোপরি আমি কি বলি
নি—আত্মদীপ ভব,
অনন্যশরণ ভব ?
প্রসেনজিত ।।ভগবন,
আপনার চিন্তা ও
কর্মধারার সমালোচনা
করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়
।আপনি আমাদের ধৃষ্টতা
ক্ষমা করুন ।
(কোশলরাজ প্রসেনজিত ও
মিগারমাতা বিশাখা
বুদ্ধের চরণে প্রণত
হ’ন। বিশাখা
কমলকলিকাটি বুদ্ধচরণে
নামিয়ে রাখেন । তারপর
মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে
বেরিয়ে যাবেন । আনন্দের
মুখে হাসি ।)
বুদ্ধ ।। আনন্দ, তোমার
হাস্যের হেতু কি?
আনন্দ ।। ভগবন, হাসছি এই
কথা ভেবে যে, মিগারমাতা
বলেছেন যে, আমরা তথাগতর
ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট
হয়েই প্রব্রজ্যাকামী
হয়েছি । তথাগতর ধর্ম ও
দর্শনে প্রবেশ লাভ করতে
পারি নি ।
বুদ্ধ ।। আনন্দ, এ কথা
বহুলাংশে সত্য । আর সে
কারণেই এ পরিহাসের বিষয়
নয় । এ এক ভয়ঙ্কর সত্য ।
আজ হতে বহু শতাব্দী পর,
যখন আমরা কেউ
কায়িকরূপে অবস্থান করব
না, এই তথাগতের
মহাপরিনির্বাণের বহু
বহু শতাব্দী পরে যখন এই
শরীরের ভস্মাবশেষ,
একগুচ্ছ কেশ, একটি
নখাগ্রের উপর শত শত
স্তূপ রচিত হবে, এই
কায়াকে অবলম্বন করে শত
শত আলেখ্য, সহস্র সহস্র
মূর্তি নির্মিত হবে,
তখন তথাগতর শিক্ষা
বিস্মৃত হয়ে, মানুষ
তথাগতর ব্যক্তিরূপেরই
মাত্র উপাসনা করবে ।
যখন কোন সমাজ বা
রাষ্ট্র সত্যকে
বিস্মৃত হয়ে কোন বিশেষ
ব্যক্তিমায়ায় নিজ
চিন্তা, বুদ্ধি ,
শুভবোধকে আচ্ছন্ন করে,
তখনই সেই সমাজ বা
রাষ্ট্রের ঘোর দুর্দিন
সমাসন্ন হয় । তাই বলছি
আনন্দ,এ পরিহাসের বিষয়
নয়, এ অতি ভয়ঙ্কর বাস্তব
সত্য ।
( আনন্দ
বুদ্ধের পদপাতে প্রণত
হন । আলো নিভে আসে ।)
( আলো জ্বললে দেখা যাবে
প্রেক্ষাপট পাল্টে
গেছে । সেই নাটকের
মহড়া-কক্ষ । অন্ধকার
রাত্রির দৃশ্য, বনভূমি
। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে ।
ঝড়ের শব্দ, সমুদ্রের
বিকট গর্জন । আন্দোলিত
বনস্পতি সমূহ । কোথাও
ধস নামার শব্দ, কানে
তালা লাগানো বজ্রনিনাদ
। ভৌতিক পরিবেশ ।
মঞ্চের একপাশ পাশ থেকে
৫ জন পুরুষ ও অন্যপাশ
থেকে ৫ জন নারী আবহ
সঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য
করতে করতে বেরিয়ে আসবে
। আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে
পাখোয়াজ অবশ্যই
দ্রুততালে বাজবে ।)
আবহ সঙ্গীত
চমকিত উদ্ভাস,
বিদ্যুত-টঙ্কার,
নিশীথ রাত্রি, ঝঞ্ঝার
ঝঙ্কার--
অরণ্যে হাহারব,
আঁধারের উৎসব
চূর্ণ হল রে নীড়,দারুণ
ঝড়।
অম্বর- নাকাড়ার ভীষণ
গর্জন;
বিপদসংকুল বনপথ
নির্জন—
তমোময়ী রাত্রি
অশরীরি যাত্রী,
রুধিরপিপাসায় স্খলিত
স্বর।।
(নর্তক-নর্তকীদের
প্রস্থান)
(রাজা
বিক্রমাদিত্যের
প্রবেশ । কাঁধের উপর
বেতাল, পেছন থেকে দুই
হাত দিয়ে রাজা
বিক্রমাদিত্যের
কণ্ঠদেশ জড়িয়ে আছে ।
রাজার হাতে খোলা
তলোয়ার, সোজা হয়ে
হাঁটছেন । নেপথ্যে ঝড়ের
জোর শব্দ ।)
বেতাল ।। রাজা, আপনি
বিচক্ষণ ও অসমসাহসী ।
তা না হোলে, একটা মৃতদেহ
কাঁধে ক’রে এই
বিপদসংকুল দীর্ঘ ও
নির্জন বনপথ অতিক্রম
করে সেই কাপালিকের
মন্দিরে অন্ধকার
রাত্রিতে গমন করা—না,
না, এ তো সহজ লোকের কর্ম
নয় বাপু ! অতএব, আপনি যে
নির্ভীকতার পরিচয়
দিয়েছেন, তাতে কি আপনার
সাহসের প্রমাণ হয় না ?
অ্যাঁ --
(রাজা বিক্রম নীরব ভাবে
পথ হাঁটবেন, শুধু মুখ
তুলে একটু চাইবেন
মাত্র, তারপর আবার
হেঁটে চলবেন। নেপথ্যে
জোর বজ্রপাতের শব্দ ।)
ও, আপনি কথা বলবেন না?
আপনার চাতুর্যেরও
প্রশংসা করতে হয় । কথা
বললেই আমি এখান থেকে
সাঁ-আ-ত ক’রে উড়ে পালিয়ে
সেই শিরীষ বৃক্ষের শাখা
থেকে ঝুলে থাকবো,
আপনাকেও আবার কষ্ট ক’রে
সেই পচা গলিত গন্ধময়
শবদেহ নামাতে হবে,
কাপালিকের আদেশ না
মানলে আপনার চলবে কেন?
সেই কারণেই চুপ করে
আছেন তাই না ? তাই না,
রাজা বিক্রমাদিত্য ?
(রাজা বিক্রম নীরবে
হাঁটবেন, শুধু মুখ তুলে
একটু হাসবেন মাত্র,
তারপর আবার হেঁটে
চলবেন। নেপথ্যে জোর
বৃষ্টি আসার শব্দ)
যাক, কথা যখন বলবেন না,
আর পথ যখন দীর্ঘ, তখন সময়
কাটানোর জন্য আরও একটি
আখ্যায়িকা শুরু করি ।
কি ব’লেন ?
(রাজা বিক্রম মাথা নেড়ে
সম্মতি জ্ঞাপন ক’রবেন।
বেতাল মুখভঙ্গি ক’রে
রাজার প্রতি বিরাগ
প্রদর্শণ ক’রবে)
বেশ, তবে শুনুন , মহারাজ
। দাক্ষিণাত্যে
মহিলারোপ্য নগরে
অহিংসক নামক এক রাজা
শাসন করতেন।
রাজগুরুর নিকট হতে তিনি
অহিংসা ধর্মের
মাহাত্ম্যকথা শ্রবণ
করে ছিলেন ও সর্ববিষয়ে
অহিংসাধর্ম পালন করতেন
। কাউকেই তিনি আঘাত
করতেন না, কারুর
সমালোচনাও কখন করতেন না
। রাজ্যে কেউ কোন অপরাধ
করলে তিনি অপরাধীকে
শাস্তি না দিয়ে, বুঝিয়ে
বলার চেষ্টা করতেন—কেন
এমন করা উচিত নয় । যারা
অভিযোগ আনত, তাদের তিনি
সান্ত্বনা দিতেন ।
এইভাবে চলতে থাকায়
একসময় রাজ্যে প্রভূত
অরাজকতা দেখা দিলো ।
রাজ্যে তস্কর, ঘাতক ও
অসৎ ব্যবসায়ীর সংখ্যা
বেড়েই চলল । অবশেষে
একদিন পার্শ্ববর্তী
রাজ্যের রাজা
মহিলারোপ্য নগরী
আক্রমণ করল । কি মহারাজ,
শুনছেন ?
(রাজা বিক্রম মাথা নেড়ে
সম্মতি জ্ঞাপন ক’রবেন।
বেতাল আবার মুখভঙ্গি
ক’রে রাজার প্রতি বিরাগ
প্রদর্শণ ক’রবে)
দীর্ঘকাল সৈন্যগণ
যুদ্ধ বিগ্রহ না করায়
অস্ত্রের ব্যবহার
বিস্মৃত হয়েছিল । তারা
কেউ অস্ত্র কর্মকারের
নিকট বিক্রয় করে
ফেলেছে, কারুর বা
অস্ত্রে জং ধরেছে ।
রাজা অহিংসক কিন্তু
যুদ্ধে গেলেন না, পাছে
তাঁর অহিংসা ধর্ম নষ্ট
হয়ে যায় ! হিঁ হিঁ হিঁ
হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ ! ফলত,
বৈদেশিক শত্রুর হাতে
রাজ্য গেলো, প্রাণও
গেল। কিন্তু, রাজার
কৃতিত্ব এই যে, রাজা শেষ
মুহূর্তেও অহিংসা ধর্ম
থেকে বিচ্যুত হলেন না ।
তাই না ?
(রাজা বিক্রম মাথা নেড়ে
সম্মতি জ্ঞাপন ক’রবেন।
বেতাল উত্তেজিত হয়ে ওঠে
–-)
এখন বলুন রাজাধিরাজ
বিক্রমাদিত্য, এইভাবে
মৃত্যুবরণ করবার পর
রাজা কোথায়
গিয়েছিলেন—স্বর্গে, না
কি নরকে ? রাজধর্মে
অবহেলা করার জন্য নরকে
যেতে হয়েছিল, না কি
অহিংসা পরম ধর্ম পালন
করায় তাঁর স্বর্গবাস
হয়েছিল? আমার এই কূট
প্রশ্নের উত্তর জানা
থাকা সত্ত্বেও যদি আপনি
নীরব বাক্যহীন হয়ে
থাকেন, তা হ’লে এখনই আমি
আপনার মাথা ফাটিয়ে দেব
। বলুন, বলুন...দেরী
করবেন না –
( বেতাল রাজাকে বারবার
শিরোদেশে আঘাত করতে
থাকে । বৃষ্টি কমে আসার
শব্দ ।)
রাজা বিক্রম ।। তবে শোন
রে বেতাল, সেই রাজা
অহিংসক নরকেই
গিয়েছিলেন । রাজধর্মে
সন্ন্যাসীদের মতো চরম
অহিংসা পালন করা
নিতান্ত অসম্ভব ।
রাজাকে অন্যায়ের
প্রতিবিধান করতে হবে,
তস্কর, ঘাতক,
অসদাচারণকারীদের
শাস্তি দিতে হবে । সাম,
দান, দণ্ড, ভেদ নীতি
প্রয়োগ করে শত্রু জয়
করতে হবে । রাজধর্ম
পালন না করায়, ঐ রাজার
নরকবাসই হয়েছিল ।
বেতাল ।। কেন ? কেন? রাজা
তো অহিংসা ধর্ম পালন
করেছিলেন । অহিংসা ধর্ম
পালন করায় তাঁর তো
স্বর্গে যাবারও কথা ?
রাজা বিক্রম ।। না,
অহিংসা ধর্ম তিনি পালনই
করেন নি । অহিংসা
ধর্মের মিথ্যা ধুয়া ধরে
তিনি কাপুরুষত্বই আচরণ
করেছিলেন। অহিংসা
সর্বাপেক্ষা সাহসী
মানুষের ধর্ম ।কোন
রাজাই সম্পূর্ণ ভয়হীন
হতে পারেন না । ততদূর
সাহসী হলে, রাজ্যত্যাগ
করে যাবার সাহস হোল না
কেন? রাজ্যভোগে
নিরুৎসাহী তিনি ছিলেন
না । অথচ রাজধর্ম পালন
করার বেলায় তাঁর যত
শৈথিল্য ! অতএব, রাজা
অহিংসকের নরকবাসই
হয়েছিল ।
বেতাল ।। বা, বা, বা,
চমৎকার, চমৎকার ! কিন্তু
আপনি যে কথা বলে
ফেলেছেন সম্রাট ! অতএব ,
পূর্বপ্রতিজ্ঞা মত
আমিও যে এবার শিরীষ
বৃক্ষের শাখায় ফিরে
যাবো ! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
হাঃ হাঃ হাঃ !
( বিক্রমের পৃষ্ঠ থেকে
অবতরণ করে বেতালের
পলায়ন করার চেষ্টা ।
এমন সময়ে অ্যান্ড্রু
ভেসালিয়াসের প্রবেশ ।
১৬শ শতাব্দীর
ইউরোপীয়দের জীর্ণ
পোশাক আশাক । পোশাকের
উপর একটা ছিন্ন
অ্যাপ্রণ । কোমরে
সার্জারির রক্তমাখা
ছুরি। মুখে অবিন্যস্ত
দাড়ি, গোঁফ, চুল
অবিন্যস্ত। চোখ আয়ত ও
প্রতিভাদীপ্ত ।
অ্যান্ড্রু
ভেসালিয়াসের সঙ্গে
বেতালের ধাক্কা লাগবে ।
বেতাল মাটিতে অসাড় হয়ে
পড়ে যাবে।)
ভেসালিয়াস ।। যাক,
এতক্ষণে একটা উপযুক্ত
ডেড বডি পাওয়া গেলো ।
এইবার কেটে কুটে দেখতে
হবে, গ্যালেন ঠিক বলছেন,
না কি আমি? (বেতালকে মাটি
থেকে তুলতে যায় ।)
রাজা বিক্রম ।। ( অবাক
হয়ে ভেসালিয়াসের দিকে
তাকিয়ে ) কে তুমি যুবক ?
তোমাকে তো এ দেশীয় বলে
মনে হচ্ছে না ? কি পরিচয়
তোমার ? কটিদেশে
ছুরিকাই বা নিহিত কেন ?
তুমি কি কোন অরণ্যবাসী
দস্যু ?
(দূরে বিদ্যুতের ঝলক)
ভেসালিয়াস ।। সে প্রশ্ন
তো আমিও আপনাকে করতে
পারি । কে আপনি? কোনো
ব্যারন? হাতে সোর্ড
খুলে কেউ পথ হাঁটে
নাকি?
রাজা বিক্রম ।। আমি
উজ্জ্বয়িনীর সম্রাট
বিক্রমাদিত্য । আর
তুমি?
ভেসালিয়াস ।। আমি
অ্যান্ড্রু ভেসালিয়াস
। ইউরোপ ভূখণ্ডে
ব্রাসেলসে আমার জন্ম ।
পাডুয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের
শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক
। কিন্তু সেটা আমার কোন
পরিচয় নয় । বস্তুত, আমি
একজন অ্যানাটমিস্ট, ঐ
যে আপনাদের দেশে যাকে
অস্থিতন্ত্রবিদ না কি
যেন বলে । যাক গে যাগ, এই
মড়াটা তুলতে একটু হেল্প
করুন তো, বেশ ভারি আছে ।
রাজা বিক্রম ।। মড়া বলছ
কাকে যুবক ? ও তো বেতাল !
মৃত অবশ্যই, কিন্তু
অশরীরী আত্মা ওতে ভর
করে আছে । ওকে রোজ
নিশীথে আমি কাপালিকের
কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা
করি। কিন্তু প্রতি
রজনীতে ও আমাকে কাহিনী
শুনিয়ে প্রশ্ন করে,না
উত্তর দিলেই মস্তক
চূর্ণ বিচূর্ণ ক’রে
দেবে । এদিকে কথা
বলামাত্রই ও ফিরে যায়
সেই গাছে । কি যে করি !
ভেসালিয়াস ।। রাখুন
মশাই অইসব আষাঢ়ে আজগুবি
গপ্পো । বেতাল ! হুঃ !
মৃতদেহ কখনো কথা বলে না
। ঐ দেখুন কেমন কেতরে
পড়ে আছে । হুঃ !
সার্জারির ছুরির কাছে
সব জব্দ ।
( গাছের ফাঁক দিয়ে
হাল্কা কুয়াশা মাখা আলো
এসে পড়বে একটা কাটা
গাছের গুঁড়ির উপর ।)
রাজা বিক্রম ।। কিন্তু
ও যে একটু আগে আমার
সঙ্গে কথা বলছিল?
ভেসালিয়াস ।। আরে মশাই,
আপনার সে কীর্তি আমি
দেখেছি । নিজেই ঘুমের
ঘোরে নাকী সুরে আপনি
কথা বলে যাচ্ছিলেন ।
আপনার চিকিৎসার দরকার ।
আপনি স্লিপ-ওয়াকার,
মানে ঘুমের ঘোরে হাঁটেন
, কথা বলেন; জটিল কেস ।
মরা কথা বলে ? অশরীরী
আত্মা ! ছোঃ! মরার পর আর
কিচ্ছু নেই, জানবেন ।
রাজা বিক্রম ।। কিন্তু
যুবক ! তুমি এখানে এলে
কেন?
ভেসালিয়াস ।। সে অনেক
কথা । রাত পুইয়ে যাবে ।
আমাদের দেশে
বিশ্ববিদ্যালয়ে
শবব্যবচ্ছেদের এখনো
অনুমতি নেই । শুধু
একখানা পুরানো কেতাব,
ভুলে ভরা । কবে কোন যুগে
গ্যালেন বলে একজন গ্রীক
লিখেছিল, সেটাই পড়ায় ।
গরু, বলদ এই সব জন্তু
জানোয়ারের পেট কেটে
দেখে, ভাবে মানুষের
ভেতরেও গঠনতন্ত্র সব
ওইরকম অবিকল আছে । এই
ভুল ধারণার উপর ভিত্তি
করে ঐ পুরনো কেতাবখানা
লেখা ।
রাজা বিক্রম ।।
আশ্চর্য ! গবাদি পশুর
উদরে যা আছে, মানুষের
দেহের ভিতরেও তাই-ই
অবিকল থাকবে, এমন
বিচিত্র অনুমানের কি
হেতু?
ভেসালিয়াস ।। অ্যাই ।
এই হচ্ছে কথা । দেখুন,
আপনি কেমন সহজেই বুঝে
নিলেন । আরে, হবেই তো ।
আপনি হলেন ভারতবর্ষের
মানুষ ।আপনারা তো
আমাদের ১২০০ বছর আগেই
শবব্যবচ্ছেদ মেরে
দিয়েছেন। আপনাদের জীবক,
চরক, সুশ্রুত তো আমাদের
কত আগেই মৃতদেহ কেটে সব
জেনে নিয়েছেন । আর
আমাদের পোড়া দেশে, মড়া
কাটার উপায় নেই ।
টেবিলের উপর গরু মোষ
কাটে ডোমে, আর
অ্যানাটমি ক্লাসে হবু
ডাক্তারের দল দশ হাত
দূরে নাকে রুমাল চেপে
জুল জুল করে দেখে । ছ্যা,
ছ্যা ! ঘেন্না ধরে গেলো ।
মড়া কেটে, হাত দিয়ে নাড়ী
ভুঁড়ি ঘেঁটে , একটু যে
হাতে কলমে জানবো তার
কোন উপায় নেই । কি? না,
মড়া কাটা বারণ ! কতগুলো
জোব্বা পরা পাদ্রী আর
কতকগুলো গু-খেকো কুয়োর
ব্যাং ডাক্তারের
জ্বালায় পড়াশুনা সব ডকে
উঠল ।
রাজা বিক্রম ।। তা হ’লে
তো জ্ঞানলাভের কোন উপায়
নেই ।
ভেসালিয়াস ।। উপায় নেই
ব’লে হাত পা গুটিয়ে বসে
থাকলে চলবে ? উপায় বের
করতে হবে । রাতের
অন্ধকারে কালো কাপড়ে গা
হাত পা ঢেকে চার্চের
সামনের গোরস্থানে গিয়ে
টাটকা নতুন কবর খুলে
মৃতদেহ তুলে এনে
রাতারাতি মড়া কেটে,
দেখে ছবি এঁকে রাখতাম ,
লিখে রাখতাম । সেই থেকে
গড়ে উঠল এই বই ডি
ফাব্রিকা ! ( বই তুলে
দেখায় । )
রাজা বিক্রম ।। বাঃ !
যুবক , অপূর্ব তোমার
জ্ঞানের তৃষ্ণা । নিজের
চোখের আলোয় পথ কেটে বের
করে নেবার অদম্য সাহস
তোমার সত্যই প্রশংসনীয়
।
ভেসালিয়াস ।। জানতে আর
পুরোপুরি পারলাম কোথায়
মশাই । সুযোগই পেলাম না
। কত আর লুকিয়ে লুকিয়ে
মড়া কাটা যায় । তাই চলে
এলাম এদেশে । যেখানে
শবব্যবচ্ছেদের উপর কোন
নিষেধাজ্ঞা নেই, জ্ঞান
যেখানে চিরমুক্ত – এই
ভারতবর্ষে । আমি যা
জানবো , নিজে কাটা ছেঁড়া
করে জানব । কোনো
গ্রন্থে আমার বিশ্বাস
নেই, কোনো বড়মানুষের
মুখের কথাতেও নয় ।
রাজা বিক্রম ।। তোমার
মতটা অনেকটা
চার্বাকবাদীদের মত ।
ভেসালিয়াস ।। ঐ সব
চার্বাক টার্বাক জানি
নে মশাই । ওইসব বাজে
বাকোয়াস না করে, হাত
লাগান। গলে পচে গেলেও
এতেই আমার কাজ হয়ে যাবে
। চলুন, ঐ মোটা গাছের
কাটা গুঁড়িটায় লাশটা
ফেলে মনের সুখে
মড়াটা চিরে চিরে দেখি
গ্যালেন ঠিক বলেছেন,
নাকি আমি?
( বিক্রম ও ভেসালিয়াস
বেতালকে ধরে গাছের
গুঁড়ির উপর বহন করে
নিয়ে যাবে ও স্থাপন
করবে । ভেসালিয়াস মহা
উৎসাহে সার্জারির ছুরি
বার করে মৃত দেহের উপর
ঝুঁকে পড়বে ও শিস দিয়ে
গান ধরবে।)
ভেসালিয়াস ।। আহা, এমন
স্বাধীনতার সঙ্গে
গবেষণা করার সুযোগ,
আমার মতো কালাপাহাড়ের
চোখেও জল এসে যায় ।
(অ্যাপ্রনের প্রান্তে
চোখ মুছে) বেঁচে থাকতে
সে সুযোগ কেউ আমাকে
দিলো না !
রাজা বিক্রম ।। অর্থাৎ ?
যুবক, তুমিও কি তবে মারা
গিয়েছ ? তুমিও কি তবে
প্রেত ?
ভেসালিয়াস ।। (হেসে) না
রাজা । তা নয় । মৃত্যু
অবশ্য আমার হয়েছে ।
কিন্তু আমি প্রেত নয় ।
রাজা বিক্রম ।। এ কি
অর্থহীন প্রলাপ ! এ কি
অবাস্তব সংলাপ !!
ভেসালিয়াস ।। প্রলাপ নয়
। শুনুন, রাজা । আমি
অ্যান্ড্রু ভেসালিয়াস,
ষোড়শ শতাব্দীর মানুষ।
আর আপনি উপকথার চরিত্র !
তবু সে উপকথা অনুযায়ী
আপনি প্রথম শতকের লোক ।
আমি ভুত নই, আমি আপনার
ভবিষ্যৎ ! আমরা ভিন্ন
কালের চরিত্র, একই
যুগের নই । তবু এই যে
আপনার সঙ্গে আমার দেখা
হয়েছে, সময়ের দেয়াল
পেরিয়ে— এ সবই তাঁর
ইচ্ছায় !
রাজা বিক্রম ।। ঠিক ।
সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা !
ভেসালিয়াস ।।( রাগ
দেখিয়ে) রাখুন মশাই
ঈশ্বর, ফিশ্বর ! আমি
মোটেই ঈশ্বরের কথা বলি
নি ।
রাজা বিক্রম ।। তবে
কার ইচ্ছায় ভিন্ন যুগের
মানুষ হয়েও, এই নির্জন
শ্বাপদসঙ্কুল নৈশ
বনভুমিতে
আমাদের দেখা
হ’ল, যুবক ?
ভেসালিয়াস ।।
নাট্যকারের ইচ্ছায়
মশাই, নাট্যকারের
ইচ্ছায় ! আরে বুঝতে
পারছেন না, এটা একটা
নাটক চলছে? আমরা নাটকের
চরিত্র...অভিনয় করছি
মাত্র ! সবই অভিনয় , সব
অভিনয় ...
(অসঙ্গ ও বসুবন্ধুর
প্রবেশ । পরণে বৌদ্ধ
শ্রমণের কাষায় । অসঙ্গ
দীর্ঘ, শীর্ণ ।
বসুবন্ধু তুলনায় খর্ব ও
স্থূল । উভয়ের চেহারায়
চোখে মুখে প্রগাঢ়
মনীষার ছাপ । ভেসালিয়াস
শবব্যবচ্ছেদের কাজে মন
দেয়। )
অসঙ্গ ।। ঠিক । এই
কথাটাই তখন থেকে তোমাকে
বলে চাইছিলাম, ভাই ।
দেখো, এই বিচিত্র দর্শন
যুবক আমার মনের কথাটাই
বলে দিলে । সবই নাটক,
মনের চিত্র – বিচিত্র
খেয়াল ।
রাজা বিক্রম ।। কে
আপনারা, ভদন্ত ? আমাদের
অভিবাদন গ্রহণ করুন ।
বসুবন্ধু ।। আমি
বসুবন্ধু, আর ইনি আমার
অগ্রজ আর্য অসঙ্গ ।
কল্যাণ হোক ।
রাজা বিক্রম ।।আমি
উজ্জ্বয়িনীর সম্রাট
বিক্রমাদিত্য । আর ইনি
ভিন্নদেশীয়,
শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক
অ্যান্ড্রু ভেসালিয়াস
।
ভেসালিয়াস ।।
(জনান্তিকে) বাওয়া, এদের
দেশে দেখি রাতের বেলায়
ফিলসফারদের ঘুম ভেঙ্গে
যায় !
(প্রকাশ্যে)
মশায়েরা, আমরা একটু
শবব্যবচ্ছেদে ব্যস্ত
আছি । আপনাদের আগ্রহ
থাকলে কাছে এসে দেখুন
।
অসঙ্গ ।। ( সাগ্রহে
শবব্যবচ্ছেদ দর্শন করে
)বাঃ, এইভাবে মৃতদেহ
ব্যবচ্ছেদ করে দেখলে,
অন্ত্র, তন্ত্র, শিরা,
উপশিরা, মল মূত্র পূর্ণ
শরীরের প্রতি আসক্তি
চলে যায় । বৈরাগ্যের
ভাব প্রগাঢ় হয়ে ওঠে ।
রাজা বিক্রম ।। আর্য
অসঙ্গ, আপনার হৃদয়ে
যুগপৎ বিচার ও প্রজ্ঞার
মিলন দর্শনে আমি অভিভূত
!
বসুবন্ধু ।। (রাজা
বিক্রমের দিকে ফিরে
নিম্নস্বরে) এঁকে
সাধারণ ব্যক্তি মনে
করবেন না, সম্রাট । ইনি
তক্ষশিলা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
অসাধারণ প্রতিভাবান
ছাত্র ছিলেন । এঁর
অধ্যাপকরা পর্যন্ত
এঁকে সমীহ করতেন ।
কিন্তু তীব্র
বৈরাগ্যের ও
সত্যান্বেষণের
প্রেরণায় ইনি
বিশ্ববিদ্যালয়
পরিত্যাগ করে,নির্জনে
তপস্যা করে বোধি লাভ
করেছেন ।
অসঙ্গ ।। (সোল্লাসে)
দেখো বসুবন্ধু, এদিকে
এসে দেখো । মানুষের
দেহের অভ্যন্তরে কতো
বিচিত্র রহস্য । আর এ
দেহকে নির্মাণ করেছে কে
? চিন্তা । মনই দেহকে
নির্মাণ করে, বসুবন্ধু
। শুধু দেহ কেন ? এই
সমগ্র জগতই তো মনের
নির্মাণ । মনের
চিন্তাগুলিই বাইরে
জগতের মত দেখায় । আসলে
জগত একটা স্বপ্ন, একটা
নাটক, মনের নানা কল্পনা
বাইরের জগতের রূপ ধরে
আছে । বস্তুত, জগত শূন্য
। এ জগত আসলে একটা
স্বপ্ন, একটা নাটক, একটা
অর্থহীন নাটক হে
বসুবন্ধু, একটা অর্থহীন
নাটক...
( বৃদ্ধ , উন্মাদ
সক্রেটিসের প্রবেশ ।
গ্রীক সুলভ বেশবাস ।
হাতে গ্রীসদেশীয় একটি
চিত্রিত পাত্র ।)
সক্রেটিস ।। নাটক ?
সমস্তই অর্থহীন স্বপ্ন?
তা হলে এই বিষের
পাত্রটিও কি স্বপ্ন
ছিল?
( উপস্থিত
প্রত্যেকের কাছে
পাত্রটি তুলে ধরে
প্রশ্ন করবেন )
বলো, এ কি স্বপ্ন
ছিল ? কথা বলছনা কেন কেউ?
বলো, বিষের পাত্রটিও কি
স্বপ্ন ছিলও? (সজোরে
উন্মাদ স্বরে) বলও, বলও
তোমরা, এই বিষের
পাত্রটি কি আমি স্বপ্নে
দেখেছিলাম ?
(গুরু গুরু মেঘের ডাক ।)
বসুবন্ধু ।। (এগিয়ে এসে)
আপনি...আপনি শান্ত
হোন...শান্ত হোন...কে
আপনি?
সক্রেটিস ।। (বসুবন্ধুর
দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে
এসে বসুবন্ধুর দিকে
ঈগলের মত তাকিয়ে) কে? কে
এ প্রশ্ন করলে ? কে এ
প্রশ্ন করলে ? এই
প্রশ্নই তো আমি...
এথেন্সের পথে ঘাটে করে
বেড়াতাম। মানুষ, তুমি
কে? মানু্ষ তুমি
নিজেকে জানো । বলও ,
তুমি কে? কে-এ ? দেখলাম,
কেউ জানে না । অথচ,
প্রত্যেকেই অহংকৃত,
মিথ্যা পরিচয়ে
পরিতৃপ্ত, গর্বিত ! হাঃ!
(বুড়ো আঙ্গুল ঘুরিয়ে
দেখায়) নিজেকে কেউ জানে
না। কেউ চেনে না !
রাজা বিক্রম ।।
ভদ্রমুখ, আপনার কথা
শুনে মনে হচ্ছে, আপনি
যেন ধূসর অতীতের কোন
কাহিনী বলছেন?
সক্রেটিস ।। থামো,
উপকথার নায়ক । এ কাহিনী
নয় । এ হল মানুষের
ইতিহাস, যা ক্রমাগত
পুনরাবৃত্ত হয় ।
অসঙ্গ ।। আপনি বলুন,
আপনার এই ইতিহাস শুনবার
জন্য আমরা গভীর ভাবে
আগ্রহী হয়েছি ।
আত্মত্যাগের ইঙ্গিত
আপনার এই অতীতচারণার
মধ্যে যেন আমি খুঁজে
পাচ্ছি ।
(ভেসালিয়াস মৃত দেহ
পরিত্যাগ করে এসে
দাঁড়ায়)
সক্রেটিস।।(সহসা শান্ত
স্বরে ) আমি সবাইকে এই
কথাই বলেছিলাম, যে
তোমরা কেউ নিজেকে জানো
না । অথচ অহংকারে পাগল
হয়ে গিয়ে তোমরা সবাই
ভাবো, তোমরা নিজেকে
জেনে ফেলেছ । কিন্তু
আমার কথা কেউ বুঝল না ।
বলল, আমি এথেন্সের
যুবকদের মাথা খাচ্ছি ।
আমি তাদের উৎসন্নে নিয়ে
যাচ্ছি । আমি এথেন্সের
মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর
। আমার বিচারসভা বসল ।
বিচারের নামে প্রহসন
শেষ হবার পর এথেন্সের
হোমরা চোমড়ার দল আমাকে
কারাগারে নিক্ষেপ করলো
৷ সেখানে আমার
বন্ধুস্থানীয় যুবকদের
সামনে আমার হাতে তীব্র
বিষ হেমলকের এই
পাত্রখানি তুলে দিয়ে
বিষপান করতে বলা হল ।
ভেসালিয়াস।।হ্যাঁ,আমি
আপনাকে চিনি।আপনি
সক্রেটিস।
খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম
শতকে আপনি গ্রীসে ছিলেন
। আর বসুবন্ধু, আপনারা?
বসুবন্ধু ।। আমরা আপনার
থেকে ১১০০ বছর আগে
ভারতে ছিলাম ।
রাজা বিক্রম।।
(ভেসালিয়াসের দিকে ফিরে
হেসে, নিম্নস্বরে) এও কি
নাট্যকারের ইচ্ছা, যুবক
?
ভেসালিয়াস।। (রাজা
বিক্রমের দিকে ফিরে
নিম্নস্বরে) হ্যাঁ, তাই
বোধ হয় । মাঝে মাঝে মনে
হচ্ছে সব সত্যি, মাঝে
মাঝে মনে হচ্ছে সব নাটক !
(সক্রেটিসের প্রতি)
আপনার স্মৃতিচারণা, আশা
করি এখানেই শেষ?
সক্রেটিস।। শেষ? এখান
থেকেই তো শুরু ।
ভেসালিয়াস।। তা কি করে
হবে ? মানুষের কাছে
সত্যের আলো পৌঁছে দিতে
গিয়ে বিষ পান ক’রে
আপনাকে মৃত্যুবরণ করতে
হোল । (বিষণ্ণ হেসে)
অনেকটা আমারই মতো!
সক্রেটিস ।। মৃত্যুতেই
যদি সব শেষ হয়ে যেত, হে
শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক
অ্যান্ড্রু ভেসালিয়াস,
তা হ’লে তোমার সঙ্গে
আমাদের দেখা হচ্ছে কি
ভাবে? মৃত্যুতেই সব শেষ
হয়ে যায় না ।
মৃত্যুযন্ত্রণার ভিতর
আমি ডেলফির দেবীর কাছ
থেকে একটি আদেশ শুনতে
পাই।
অসঙ্গ ।। কি আদেশ, দেব?
সক্রেটিস ।। যারা
মানুষের অন্তরে
জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে
দেবার জন্য তপস্যা করবে
ভবিষ্যতে, তাদের
প্রত্যেকের পাশে গিয়ে
আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে
হ’বে । কিন্তু এ আদেশ না
পেলেই ভালো হত ।
সকলে (সমস্বরে) ।। সে কি,
কেন ?
সক্রেটিস ।। এই আদেশের
ফলে আমি ভাবী কালের
প্রতিটি সত্যান্বেষী
মানুষের পাশে গিয়ে
দাঁড়াতে লাগলাম । আর
দেখলাম...
বসুবন্ধু ।। কি দেখলেন,
হে সক্রেটিস ?
সক্রেটিস ।। দেখলাম...
দেখলাম যুগে যুগে মানুষ
জ্ঞানের অন্বেষণে
চলেছে অভিযাত্রীর মতো ।
কি আনন্দ তাদের ।শত শত
বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে,
বিপদ তুচ্ছ করে তারা
অন্বেষণ করছে
সত্যের...বিজ্ঞানে,
সাহিত্যে,চিকিৎসা
শাস্ত্রে, সেবায়,
ত্যাগে,
আধ্যাত্মিকতায়...সর্বত্
র সেই সত্যেরই
অনুসন্ধান । আর
অন্যদিকে...
রাজা বিক্রম ।। আর
অন্যদিকে...?
সক্রেটিস ।। একটা অন্ধ
শক্তি মানুষের সকল
সত্যানুসন্ধানের পথে
বাধা দিয়ে চলেছে ।
ভেসালিয়াস ।। কি সেই
শক্তি ?
সক্রেটিস ।। সেই
দানবীয় শক্তির অন্য নাম
সমাজ ।
সকলে (সমস্বরে) ।। সমাজ
?
সক্রেটিস ।। হ্যাঁ ,
সমাজ । সমাজ এক ভণ্ড
প্রতিষ্ঠান । এই সমাজ
সত্যান্বেষীর পথে
ছড়িয়ে দেয় কাঁটা । তার
জ্ঞানকে নিজের
স্বার্থে প্রয়োগ করে ।
স্বার্থপর সমাজ
সত্যান্বেষীর পথ রোধ
করে দাঁড়ায় । তাকে
নির্বাসিত করে । তাকে
নির্মম ভাবে হত্যা করে
সমাজ ; এই ভণ্ড
প্রতিষ্ঠান!
অসঙ্গ ।। আপনি কি
দেখলেন, আমরা আরও শুনতে
চাই ।
সক্রেটিস ।। শুনবে ? শোন
তা হ’লে , যুগে যুগে ভণ্ড
সমাজ কি করেছে । তুমি
ভেসালিয়াস আর কতটুকু
দেখেছো? ডেলফির দেবীর
কৃপায় আমার অগম্য কোন
দেশ নাই, অগম্য কোন কাল
নাই । অতীত থেকে
ভবিষ্যৎ সর্বত্র আমি
গমন করেছি, দেখেছি
মানবাত্মার মর্মন্তুদ
অপমান । কয়েকটা উদাহরণ
দিই । এই ভণ্ড সমাজ
নীতিকথাকার ঈশপকে
পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে
হত্যা করেছে, ভগবান
বুদ্ধের চরিত্র হনন
করার চেষ্টা করেছে,
ঈশদূত যিশুখ্রিস্টকে
ক্রুশবিদ্ধ করেছে। এই
ভণ্ড সমাজ পঞ্চদশ শতকে
অনুপ্রেরণার শিখাময়ী
নারী জোয়ান অব আর্ককে
পুড়িয়ে মেরেছে, ষোড়শ
শতকে প্রচলিত ধর্মের
বিরোধিতার অপরাধে
ইতালীয় দার্শনিক
জর্দানো ব্রুনোর গায়ে
আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং
গ্যালিলিওকে
নির্বাসিত করে ছেড়েছে
।
বসুবন্ধু ।। আপনি
মানুষের ভবিষ্যতেও কি
সমাজের এই অত্যাচার
প্রত্যক্ষ করেছেন ?
সক্রেটিস ।। হ্যাঁ, সব
যুগেই একই ছবি।একদিকে
সৃষ্টিশীল মানুষ,
অন্যদিকে দানবীয়
স্বার্থপর সমাজ । এই
ভারতবর্ষে নানক, কবীর,
তুকারাম,
তুলসীদাস,জ্ঞানেশ্বরে
মতো সন্তরা তাঁদের
জীবৎকালে সমাজের হাতে
নিগৃহীত হবেন ।
প্রেমময়ী মীরাকে পথে
পথে ভিক্ষা করতে হবে ।
বিংশ শতকে, পাশ্চাত্যে,
এই ভণ্ড সমাজ
সাহিত্যসেবী অস্কার
ওয়াইল্ডকে কারাগারে
নিক্ষেপ করবে,
হাইসেনবারগ ধর্ম ও
বিজ্ঞানকে মেলাতে
চাইবেন বলে বিজ্ঞানী
মহল থেকে তাঁকে বের করে
দেবে, আইনস্টাইনের
যুগান্তকারী তত্বকে
ব্যবহার করে ভয়ানক
মারণাস্ত্র বানিয়ে
লক্ষ লক্ষ নিরীহ
মানুষের প্রাণনাশ করবে,
যার জন্যে মহাবিজ্ঞানী
খেদ করে বলবেন, ‘পরের
জন্মে যদি মানুষ হয়ে
আসি, আর বিজ্ঞানী না হয়ে
মদের দোকানের বেয়ারা
হয়ে জন্মাবো’।
ভেসালিয়াস।। কি ভয়ঙ্কর
মানুষের ভবিষ্যৎ !
সক্রেটিস ।। এ আর
কতটুকু বলেছি, হে ?এই
ভণ্ড সমাজ আরও কি করবে
শোন। জার্মান দার্শনিক
নীতসেকে বদ্ধ উন্মাদে
পরিণত করবে আর
মনস্তত্ববিদ ফ্রয়েডকে
তার নিজের মেয়ের সঙ্গে
অসুস্থ জীবন কাটাতে
বাধ্য করবে । আর আমাদের
কালে ? আমাকে বিষ পান করে
মরতে হয়েছে, আর তোমাকে ,
ভেসালিয়াস, স্বদেশে
পরবাসী হয়ে থাকতে হয়েছে
!
রাজা বিক্রম ।। ওঃ, আমরা
আর সহ্য করতে পারছি না
।কি ভয়ঙ্কর ! (বিদ্যুতের
ঝলসানি)
সক্রেটিস ।। তবু সহ্য
করতে হবেই । এই ঘোর
কালকূট, এই তীব্র বিষ, এই
তো বাস্তব...এই
যুগযুগান্ত -মন্থিত
হেমলকের মৃত্যুনীল
যন্ত্রণা সহ্য করাই
সৃজনশীল মানুষের নিয়তি
। ( হেমলকের পাত্র তুলে
ধরে ) এক হিসাবে এই তো
অমৃত । এই বিষ পান করেই
তো সত্যান্বেষী মানুষ
যুগে যুগে অমর হয়েছে ।
কে আছে, কার সাহস আছে
সত্যের জন্য এ বিষ পান
করার ? যে পান করবে, সেই-ই
অমর হয়ে যাবে । এসো, পান
করো । ক্ষুদ্র স্বার্থ
পরিত্যাগ করে এ অমৃত
পান করবে কে ? এসো !
( হেমলকের পাত্র দুই
হাতে উঁচু করে ধরবে ।
অন্যরা সবাই
সক্রেটিসকে কেন্দ্র
ক’রে বৃত্তাকারে
নতজানু হয়ে বসে
পাত্রটির দিকে ডান হাত
বাড়িয়ে ধরবে । ফ্রিজ
হয়ে যাবে । আবহে
রবীন্দ্রনাথের ‘ এরা
পরকে আপন করে, আপনারে
পর’ গানের সুর বেজে
উঠবে । সুর থামলে
মঞ্চের সকলেই ফ্রিজ
অবস্থা থেকে স্বাভাবিক
অবস্থায় এসে হাসতে
হাসতে কথা বলতে বলতে
মঞ্চের একদিক দিয়ে
বেরিয়ে যাবে । অন্যদিক
দিয়ে আন্দোলন ও আলেখ
ঢুকবে । )
আন্দোলন ।। এ নাটকটা
তবু মেনে নেওয়া যায় ।
যদিও এখানেও জগাখিচুড়ি
বিস্তর, অবাস্তব ঘটনা
ঘটিয়েছ প্রচুর, তবু
মেসেজ আছে একটা ।
অবিশ্যি সোসাইটিকে
অতটা গাল না দিতেও
পারতে । ওটা আমার অতটা
ভালো লাগে নি , বুঝলে ।
আফটার অল এই সোসাইটিতে
বাস করেই তো আমাদের করে
খেতে হয় । নয়?
আলেখ ।। তা ঠিক,
সোসাইটিতেই বেঁচে
থাকতে হয়, এখানেই
‘নাটক’ করতে হয় ।
আন্দোলন ।। তার পর দেখো,
সোসাইটিতে ভালো লোক কি
নেই?
আলেখ ।। আছে । তবে তারা
এতোই ভালো মানুষ, যে
কখনো কোন অন্যায়ের
প্রতিবাদ করার মতো সাহস
তাদের নেই । দে আর গুড,
বাট ফর অল
প্র্যাক্টিকাল
পারপাসেস দে আর গুড ফর
নাথিং ।
আন্দোলন ।। (হেসে) আচ্ছা,
সৃজনশীল মানুষেরা তো
একযোগে সংঘবদ্ধ হয়ে
আন্দোলন করতে পারে । না
কি?
আলেখ ।। তাতে একটু
অসুবিধে আছে । সৃজনশীল
মানুষের মধ্যে সবসময়ই
একটা নিজস্বতা থাকে,
স্বাতন্ত্র থাকে, যেটা
তাকে একটু আলাদা করে
টেনে রাখে । আর যাই হোক
সৃজনশীল মানুষ তো আর
ঝাঁকের কই হয়ে ঝাঁকে
মিশে যেতে পারে না ।
আন্দোলন ।। তবে এ
নাটকটা তোমার ঐ আগের
যেটা পড়তে দিয়ে ছিলে, ঐ
যে কি ‘আত্মহত্যা’ না
কি যেন, তার থেকে শতগুণে
ভালো । আগের নাটকটা
একেবারে অবাস্তব । তুমি
একটু বাস্তব সিচুয়েশন
তৈরী কর, আলেখ ।
( সেল ফোন বেজে ওঠে ।
পকেট থেকে সেল ফোন বের
করে নাম্বারটা দেখে
তাড়াতাড়ি সুইচ টিপে সেল
ফোনটা কানে দেয় ।)
হ্যালো... হ্যাঁ বলো...আমি
আলেখদের ক্লাবে ...কি?
ক্কি?...কখন?......তুমি এখন
কোথায়?...... আচ্ছা,
ও...এক্ষুনি আসছি । (ফোন
কেটে দেয়, পাথরের মতো
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে
থাকে । )
আলেখ ।। কি হোল
আন্দোলনদা, কার ফোন?
আন্দোলন ।। সঞ্চারী ফোন
করেছিলো ।
আলেখ ।। কি হোল ? কোন
খারাপ খবর ? সঞ্চারীদির
কিছু হয়েছে?
আন্দোলন ।। না, না,
সঞ্চারী ঠিকই আছে,
কিন্তু মেয়েটা...এটা ও কি
করল, কি করল?
(রুমাল বের করে মুখ
চেপে ধরে)
আলেখ ।। কে? তিয়াসা? কি
হয়েছে তিয়াসার? বলছেন
না কেন, আন্দোলনদা?
আন্দোলন ।। আমার
মেয়ে...মেয়েটা...অনেকগুলো
ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছে
। সঞ্চারী অফিস থেকে
এসে দেখে মুখে গ্যাজলা
বেরোচ্ছে ।
আলেখ ।। এখন কোথায়?
আন্দোলন ।। বলল, আই জি
এম-এ । এক্ষুনি যেতে হবে
আলেখ ।
আলেখ ।। ঈশ্, ডক্টরেট
করা মেয়ে তিয়াসা, কেন
এমন করলো সে ?
আন্দোলন ।। টেবিলের উপর
সুইসাইডাল নোট । কে
নাকি তিয়াসাকে ফলো করত,
সেলফোনে নোংরা নোংরা
মেসেজ পাঠাত, ভয় দেখাত ।
দিনের পর দিন মেয়েটা
কাউকে কিচ্ছু বলে নি ।
তারপর মানসিক চাপ না
নিতে পেরে...(বিষন্ন হেসে
) অনেকটা তোমার ঐ
অবাস্তব নাটকটার মতই ।
আলেখ ।। চলুন, চলুন, দেরী
হয়ে যাচ্ছে । এখনি
বেরিয়ে পড়তে হবে ।
তিয়াসা কি অবস্থায় আছে
কে জানে !
আন্দোলন ।। ( বিষণ্ণ
ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি)
চলো ।
(দুজনে
বেরিয়ে যায় । আলো নিভে
আসে ।)
।...............।
ফেসবুক মন্তব্য